ছবি: সংগৃহীত।
মেট্রো ডেয়ারির শেয়ার হস্তান্তর মামলায় রাজ্যের অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী-সহ চার আমলার বক্তব্য জানতে তারা নোটিস দিয়েছে বলে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) সূত্রে জানা গিয়েছে। ওই সূত্রের বক্তব্য, সচিবদের আগামী ২২ জুন ইডি’র কলকাতা অফিসে যেতে বলা হয়েছে। দ্বিবেদী ছাড়া অন্য তিন আমলা হলেন ভগবতীপ্রসাদ গোপালিকা, রাজেশ সিংহ এবং রাজীব কুমার (আইএএস)। ২০১৭-১৯ সালের মধ্যে এঁরা প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের সচিব ছিলেন।
ইডি (অধীর চৌধুরীর মামলার সূত্রে যারা তদন্তে নেমেছে) সূত্রে জানানো হয়েছে, মেট্রো ডেয়ারির নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে রাজ্য দুগ্ধ ফেডারেশন পরিচালনার ভার ছিল প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের হাতে। ফলে মেট্রো ডেয়ারির শেয়ার বিক্রি সংক্রান্ত প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে বিভাগীয় সচিবদের বক্তব্য জানা প্রয়োজন। বিশেষত যেখানে অভিযোগ উঠেছে যে শেয়ার বিক্রি করে রাজ্য সরকার আরও বেশি অর্থ পেতে পারত।
নোটিস প্রসঙ্গে কলকাতায় ইডি’র বিশেষ অধিকর্তা যোগেশ গুপ্ত ফোনে বা মেসেজে কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। তবে ইডি’র এক শীর্ষ আধিকারিকের কথায়, ‘‘চার কর্তাকে ডাকা হয়েছে। মেট্রো ডেয়ারির শেয়ার হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় যে তথ্য মিলেছে, তাতে ওই আইএএস অফিসারদের বক্তব্য জানা প্রয়োজন। করোনা পরিস্থিতির কারণে আসতে না পারলে ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে তাঁরা হাজির হতে পারেন। নোটিসের সঙ্গে প্রশ্নও পাঠানো হয়েছে।’’
আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় শহরে পজ়িটিভ ১৫৮ জন, নতুন রেকর্ড গড়ল কলকাতা
আরও পড়ুন: অবস্থান বদলাচ্ছে না ভাড়া বাড়ানো নিয়ে, জেদের লড়াইয়ে অচল বাস
রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিংহকে এ বিষয়ে মেসেজ করা হলে তিনি উত্তর দেননি, ফোনও ধরেননি। ভগবতীপ্রসাদ গোপালিকা, রাজেশ সিংহও ফোন ধরেননি এবং রাত পর্যন্ত মেসেজের উত্তর দেননি। রাজীবের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। নবান্ন সূত্রের খবর, নোটিস প্রসঙ্গে এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। যদিও ওই নোটিস অনুযায়ী প্রশ্নের লিখিত জবাব দেওয়ার সংস্থান রয়েছে। নবান্নের তরফে পাল্টা বলা হচ্ছে, রাজ্যের চার সিনিয়র আইএএস অফিসারকে ডেকে কেন্দ্রীয় সরকার ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’ করছে। কারণ, আইন মেনেই, স্বচ্ছ ভাবে মেট্রো ডেয়ারির শেয়ার বিক্রি করা হয়েছিল এবং রাজ্য মন্ত্রিসভার সম্মতিতেই তা হয়েছিল। এক শীর্ষ আধিকারিকের কথায়, ‘‘সব নিয়ম মেনে শেয়ার বিক্রি করা হয়েছিল। তারপর সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থা সেই শেয়ারের অংশ কাকে বিক্রি করবে, কত দরে বিক্রি করবে, তা তাদের ব্যাপার। এখানে সরকারের দায় কী? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ইডি কেন ওই সংস্থার কর্তাদের না ডেকে সরকারি আমলাদের বার বার ডাকছে?’’
তবে কি বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়েই আচমকা এই চার কর্তাকে ডাকা হল? বিশেষত এই সময়ে, যখন দিল্লির শীর্ষ স্তর থেকে ক্রমাগত নরমে-গরমে ভোটমুখী বার্তা দেওয়া হচ্ছে? এই প্রশ্নে ইডি’র এক কর্তার দাবি, ‘‘আর্থিক অপরাধের অভিযোগের মামলায় নির্দিষ্ট তথ্য হাতে না নিয়ে পদক্ষেপ করা হয় না। অর্থসচিব-সহ চার আমলাকে যখন ডাকা হচ্ছে, তখন বোঝা উচিত, তথ্য হাতে না নিয়ে আমরা কিছু করছি না।’’
মেট্রো ডেয়ারি বিক্রির গোড়ার কথা
প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, মেট্রোতে কেভেন্টার্সের শেয়ার ছিল ৫৩ শতাংশ। রাজ্য দুগ্ধ ফেডারেশনের হাতে ছিল ৪৭ শতাংশ। বছর তিনেক আগে কেভেন্টার্স মেট্রো ডেয়ারির সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণে ২০০ কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব দেয়। ফেডারেশনেরও ১০০ কোটি লগ্নির কথা ছিল। ফেডারেশনের চেয়ারম্যান, তৃণমূল বিধায়ক পরশ দত্ত এ প্রসঙ্গে গত বছর অক্টোবরে আনন্দবাজারকে বলেছিলেন, ‘‘মেট্রো ডেয়ারির সম্প্রসারণের জন্য কেভেন্টার্স ২০০ কোটি টাকা ঢালার প্রস্তাব দিয়েছিল। ১০০ কোটি টাকা দিতে হত ফেডারেশনকে। সেই টাকা না থাকাতেই শেয়ার বিক্রি করতে হয়েছে। নিয়ম মেনে, স্বচ্ছতার সঙ্গে শেয়ার বিক্রি হয়েছে। মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে লুকোনোর কিছু নেই।’’
তা হলে বিতর্ক কোথায়?
মেট্রো ডেয়ারির ৪৭% শেয়ার ছিল দুগ্ধ ফেডারেশনের হাতে। প্রক্রিয়া মেনে সেই ৪৭% শেয়ার ৮৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয় কেভেন্টার্সকে। তার কিছু দিনের মধ্যেই মেট্রোর ১৫% শেয়ার ১৭০ কোটি টাকায় সিঙ্গাপুরের একটি প্রাইভেট ইকুইটি ফান্ডকে বিক্রি করে কেভেন্টার্স। কেভেন্টার্স যে দরে শেয়ার বেচেছে, রাজ্য তা পেলে কোষাগারে ৫০০ কোটি টাকা আসত— এই দাবি করে হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন লোকসভায় বিরোধী দলনেতা অধীর চৌধুরী। ওই মামলায় ইডিকে পক্ষ করা হয় এবং সেই সূত্রে তারা তদন্ত শুরু করে। ইডি জানিয়েছিল, যেহেতু সিঙ্গাপুরের সংস্থা লগ্নি করেছে, তাই ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট’ (ফেমা)-র আওতায় অভিযোগের তদন্ত করা হবে। রাজ্যের তরফে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় নথি দেওয়াও হয় ইডিকে।
প্রাণিসম্পদ দফতরের স্পষ্ট বক্তব্য, সমস্ত নিয়মকানুন মেনেই বিক্রি হয়েছে মেট্রো ডেয়ারি। সে সময় অর্থ দফতর ৪৭ শতাংশ শেয়ারের মূল্য ঠিক করার জন্য দরপত্র ডেকে ভ্যালুয়ার নিয়োগ করেছিল। সেই সংস্থা খতিয়ান (বুক ভ্যালু) অনুযায়ী ৭০ কোটি টাকা মূল্য নির্ধারণ করেছিল। তখন একটি নামী অডিট সংস্থাকে ফের বাজারমূল্য নির্ধারণ করতে বলা হয়। সর্বশেষ দাম ঠিক হয় ৮৪.৪৩ কোটি। পর পর দু’বার দরপত্র চেয়ে কেভেন্টার্সকেই একমাত্র ক্রেতা হিসেবে পাওয়া যায়। দফতরের বক্তব্য, কেভেন্টার্স পরে কাকে শেয়ার বিক্রি করেছে, তার দায় সরকারের নয়।
২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর মিল্ক ফেডারেশনের ম্যানেজার (কোয়ালিটি অ্যাসিয়োরেন্স) তাপস কর, ১৫ অক্টোবর ফেডারেশনের তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর দেবব্রত চক্রবর্তীকে সল্টলেকের অফিসে ডেকে পাঠায় ইডি। ১৬ অক্টোবর ডাকা হয়েছিল পরশ দত্তকে। প্রত্যেকেই নিজের বক্তব্য জানিয়ে দিয়েছিলেন।