প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
তাঁরা বিভিন্ন সংস্থার ডিরেক্টর, কিন্তু বেতন সাকুল্যে হাজার পনেরো টাকা! তদুপরি তদন্তকারীদের প্রশ্নের মুখে তাঁদের স্বীকারোক্তি, ওই সব সংস্থা কী কাজ করে, সেই ব্যাপারে তাঁদের কোনও সম্যক ধারণাই নেই!
প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমে তারা এমনই চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছে বলে ইডি বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের দাবি। স্কুলে নিয়োগ-দুর্নীতির জেরে আপাতত জেলবন্দি পার্থের বিরুদ্ধে শেয়ার কেলেঙ্কারিরও নানা অভিযোগ উঠে আসছে ইডি-র তদন্তে। বুধবার কলকাতার বিচার ভবনের বিশেষ ইডি আদালতে তদন্তকারীরা জানান, ২০১টি কাগুজে সংস্থার খোঁজ মিলেছে। সেই সব সংস্থার ১০ টাকার শেয়ারকে কারসাজি করে এক হাজার টাকা হিসাবে প্রায় দু’কোটি সত্তর লক্ষ কালো টাকা সাদায় পরিণত করা হয়েছে। পার্থের জেলবন্দি বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে জেরা করেই ওই সব কাগুজে সংস্থার নাম জানা গিয়েছে বলে ইডি-র দাবি।
তদন্তকারীরা জানান, ওই সব কাগুজে সংস্থার বিভিন্ন ডিরেক্টরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁদের অধিকাংশই স্বল্পশিক্ষিত এবং দরিদ্র। সংস্থাগুলি কী কাজ করে, তা-ও তাঁরা জানেন না। ওই গরিব মানুষগুলিকে সামনে রেখেই পার্থ যাবতীয় কারসাজি করেছেন। ইডি-র আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি এ দিন কোর্টে পার্থকে ‘অমানবিক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘‘মাত্র ১৫ হাজার টাকা বেতনের বিনিময়ে ওই সব সংস্থায় বিভিন্ন লোককে ডিরেক্টরের পদে নিয়োগ করা হয়েছিল!’’
ইডি-র আইনজীবী অভিজিৎ ভদ্র এ দিন বলেন, ‘‘জেলে গিয়ে পার্থ ও অর্পিতাকে জেরা করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পরপর বেআইনি লেনদেনের হদিস পাওয়া যাচ্ছে। আরও কাগুজে সংস্থার হদিস মিললেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।’’
এই ধরনের লেনদেনের বিষয়ে আরও তদন্তের জন্যই পার্থকে জেলে রাখা প্রয়োজন বলে এ দিন কোর্টে জানিয়েছে ইডি। যদিও পার্থের আইনজীবী হারাধন মুখোপাধ্যায় যে-কোনও শর্তে তাঁর মক্কেলকে জামিন দেওয়ার আর্জি জানান। এমনকি, প্রয়োজনে পার্থ গৃহবন্দি থাকবেন এবং সেখানেই তাঁকে জেরা করা যাবে বলেও জানান তিনি। এ দিন জেল থেকেই পার্থ-অর্পিতাকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে হাজির করানো হয় বিচারক জীবনকুমার সাধুর এজলাসে। তাঁদের আইনজীবীরা জেলেও ছিলেন। দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে পার্থ-অর্পিতাকে আরও ১৪ দিন জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। পার্থের আইনজীবীরা ভার্চুয়ালি হাজিরার বিরোধিতা করেন। তাঁরা জানান, তাঁদের মক্কেল সশরীরে শুনানিতে অংশ গ্রহণ করতে চান। এর পরে বিচারক জানান, ভার্চুয়ালি হাজিরার সিদ্ধান্ত কারা-কর্তৃপক্ষের।পার্থের আইনজীবীরা এ দিন দাবি করেন, ইডি-র তরফে যে-সব নথি আদালতে পেশ করা হয়েছে, তার কোনওটির সঙ্গেই তাঁদের মক্কেলের নাম জড়িত নয়। জেলবন্দি পার্থের নানান শারীরিক সমস্যা আছে। তা বিবেচনা করে জামিন দিক কোর্ট।
আইনজীবীরা নথিতে পার্থের নাম নেই বলে দাবি করলেও ইডি-র দাবি, ইতিপূর্বেই পার্থ ও অর্পিতার নামে থাকা দু’টি সংস্থা ‘অপা ইউটিলিটি সার্ভিসেস’ ও ‘অনন্ত টেক্সফ্যাব প্রাইভেট লিমিটেড’-এর সন্ধান মিলেছে। ইডি এ দিন কোর্টে জানায়, ওই দুই সংস্থার নামে শতাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে।
পার্থ-অর্পিতার যোগসূত্র বোঝাতে এ দিনেও ফের বিমা সংস্থার নথিকে হাতিয়ার করেন ফিরোজ। পার্থ কী ভাবে ‘আঙ্কল’ পরিচয়ে অর্পিতার ‘নমিনি’ হলেন, সেই প্রশ্ন আগেই উঠেছে। পার্থের আইনজীবীদের দাবি, নমিনি হলেও পার্থ ইচ্ছে করলেই সেই টাকা তুলতে পারতেন না।
এই সব কিছুর মধ্যে সমানে মিলছে স্থাবর সম্পত্তির খোঁজ। সম্প্রতি উত্তর ২৪ পরগনায় একটি পিকনিক স্পট ও রিসর্টের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। ইডি জানিয়েছে, কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির রাজপুর-সোনারপুর পুরসভা এলাকার রায়পুরে অপা ইউটিলিটি সার্ভিস কোম্পানির নামে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জমির খোঁজ মিলেছে। তা ছাড়া দু’টি শিক্ষা কেন্দ্রের সঙ্গে পার্থের অর্থ বিনিয়োগের চুক্তি হয়েছিল। সেই সব চুক্তিপত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী অফিসার।
পার্থের সশরীরে শুনানিতে অংশগ্রহণের আর্জি প্রসঙ্গে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘আদালত চাইলে হবে। এখানে আমাদের কিছু বলার নেই। পার্থবাবুর উচিত, আর চুপ করে না-থেকে কারা কারা এর সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের পর্দা ফাঁস করা।’’