বিধি-ভঙ্গ: গরম দুপুরে রাস্তার জলের কলে ভিড় পথচারীদের। মাস্ক পরে নেই অনেকেই। সোমবার, ধর্মতলায়। নিজস্ব চিত্র
এ রাজ্যে উৎসবের দিন যত কড়া নাড়ছে, কোভিড ১৯ সংক্রমণও যেন তত আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। পৃথিবীর কোনও সংক্রমিত দেশেই জনজীবন স্বাভাবিক রেখে ফ্লু গোত্রের এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকানো যায়নি। কারণ, নিজেকে ও পরিবারকে সুস্থ রাখতে মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত ধোয়া, স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া, দূরত্ব-বিধি বজায় রাখার মতো জরুরি পন্থা উড়িয়ে দেওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়। দু’জনের মধ্যে ছ’ফুট দূরত্ব থাকার পরামর্শ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিলেও তা ভারতের মতো ঘন জনবসতির দেশে উৎসবে তো বটেই, প্রতিদিনও মেনে চলা অসম্ভব।
তথ্য বলছে, এ দেশে সংক্রমণের তীব্রতা কমছে। এটি সুখবর হলেও রেখচিত্র আর যে ঊর্ধ্বমুখী হবে না, তা কিন্তু বলা যায় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিশ্বের কয়েকটি দেশ যখন সংক্রমণ হ্রাসের পরে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে চেয়েছিল, তখনই কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা এ জন্য আঙুল তুলছেন বড় অংশের জনগণের মাস্ক না পরা, জমায়েত করা, দূরত্ব-বিধি না মানার মতো আচরণের দিকে।
উৎসবে ঘরবন্দি থাকা কষ্টদায়ক হলেও, পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে এই বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তই বিপদকে ঠেকাতে পারে। মনে রাখতে হবে, কোভিড ১৯ সংক্রমিত হওয়া অনেকটাই নির্ভরশীল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপরে। স্থানভেদে ও আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে ভাইরাসের চরিত্রও বদলাচ্ছে। বহু সংখ্যক ভাইরাসের উপস্থিতির কাছে প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক সময়েই হার মানে। মানুষের শরীরে ঢুকে ভাইরাসের সংখ্যা দ্রুত কয়েক গুণ বাড়তে পারে। তখনই হার মানে প্রতিরোধ ক্ষমতা।
এর সঙ্গেই রয়েছে উপসর্গহীন মানুষের সংস্পর্শের ঝুঁকি। আমি বাইরে থেকে রোগের জীবাণু আনলাম। আক্রান্ত হয়েও উপসর্গহীন থাকলাম। ঘরের বয়স্ক মানুষটি আমার সংস্পর্শে আক্রান্ত হলেন। রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার বা রোগ নির্ণয়ের আগেই আমরা অনিচ্ছাকৃত ভাবে কিছু মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারি। তাই জনবহুল স্থান ও জমায়েত এড়িয়ে চলাই বাঞ্ছনীয়। উৎসবে রাস্তায়, মণ্ডপে, যানবাহনে দূরত্ব-বিধি সংক্রান্ত নজরদারি চালানো প্রশাসনের পক্ষে দুরূহ। সে ক্ষেত্রে মানুষের পরিমিত পদক্ষেপই পারবে সংক্রমণকে প্রতিহত করতে।
এ দেশে কোভিড সংক্রমণের তীব্রতা সমষ্টিগত ভাবে নিম্নমুখী, বহু আক্রান্ত সুস্থ হয়েছেন― এ সবই আশাব্যঞ্জক সংবাদ। অন্য চিত্র বলছে, কিছু আঞ্চলিক স্তরে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। কম সময়ের মধ্যে আক্রান্তের দ্বিতীয় বার সংক্রমিত হওয়ার সংবাদও যথেষ্ট উদ্বেগের। গোষ্ঠীবদ্ধ কোভিড ১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতা কবে, কী ভাবে তৈরি হবে বা আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে। তাই আপাতত নিয়ন্ত্রিত জীবনই আগামী দিনকে সুরক্ষিত করতে পারে।
কোভিড ১৯ সংক্রমিত বহু মানুষ সুস্থ হয়ে উঠছেন ঠিকই তবে সংক্রমণ ও তার চিকিৎসার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে অন্য সমস্যাও সঙ্গী হচ্ছে। সংক্রমিত হলেই যেমন মৃত্যু-ভয় নেই, তেমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কাও প্রবল।
ভুললে চলবে না, চিকিৎসা পরিষেবা আজ বিপর্যস্ত। এখনই সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা নেই। এই অবস্থায় উৎসবে শামিল হলে একসঙ্গে বহু মানুষ সংক্রমিত হবেন। ফলে দুর্বল চিকিৎসা পরিকাঠামোর উপরে আরও অস্বাভাবিক চাপ পড়বে। আমার আনন্দ যেন অন্যের বিপদের কারণ না হয়ে ওঠে, এই প্রাসঙ্গিক সত্য বাস্তবায়িত করার সময় এসেছে।
ইতিমধ্যেই বহু চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী তাঁদের কর্তব্য পালন করতে গিয়েই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছেন। বাকি চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের উপরে এখন অতিরিক্ত চাপ তৈরি না করাই হবে সচেতন নাগরিকের কর্তব্য। এই সময়ের সচেতনতা ও নিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপই কোভিডমুক্ত সকাল দেখাতে পারে।
সচেতন থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মানুন, চেষ্টা করুন আপনজন ও প্রতিবেশীদের সচেতন করে তুলতে। নয়তো বিধিনিষেধ ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা দীর্ঘায়িত হবে।
লেখক: গণিত ও রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক, আইআইটি কানপুর