সরকার থেকে যাওয়ার ১২ বছরের মধ্যেই আর্থিক অনটন বঙ্গ সিপিএমে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বঙ্গ সিপিএমে অনটন!
সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলির সম্পত্তির পরিমাণ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ ডেমোক্রেটিক রিফর্মস’ (এডিআর)। তাতে দেখা গিয়েছে, ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে সারা দেশে সিপিএমের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৭৩৫.৭৭ কোটি টাকা। কিন্তু সেই অঙ্ক যতই চোখে লাগার মতো হোক, বঙ্গ সিপিএমকে গ্রাস করছে অনটন। যার জেরে রাজ্যের অনেক জেলায় সর্বক্ষণের কর্মী (হোলটাইমার) নিয়োগ থমকে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। তার মধ্যে অন্যতম কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনা।
সিপিএম সূত্রের খবর, কলকাতা জেলায় শেষ বার সর্বক্ষণের কর্মী নিয়োগ হয়েছিল ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তার পর আর কাউকে নেওয়া হয়নি। উত্তর ২৪ পরগনায় শেষ বার সর্বক্ষণের কর্মী নেওয়া হয়েছিল ২০১৩ সালে। দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এই জেলা শুধু গত বছর জেলা সম্মেলনের পর এক জনকে সর্বক্ষণের কর্মীর স্বীকৃতি দিয়েছে। তা-ও তিনি জেলা কমিটির সদস্য হওয়ার পর। অন্যান্য জেলাতেও এই একই অবস্থা বলে খবর। ব্যতিক্রম হুগলি জেলা। সংখ্যায় কম হলেও ফি বছর ওই জেলা হোলটাইমার নিয়োগ জারি রেখেছে বলে খবর। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতেও পরিস্থিতি ‘শোচনীয়’ বলে দলীয় সূত্রের বক্তব্য।
কলকাতা এবং উত্তর ২৪ পরগনা নিয়ে সিপিএমের অন্দরে আলোচনা বেশি হচ্ছে। কারণ, ওই দুই জেলারই হোলটাইমার নিয়োগে ধারাবাহিকতা ছিল। কিন্তু তারাও থমকে গিয়েছে। সিপিএম সূত্রের খবর, বিভিন্ন জেলাতেই সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ার জন্য বহু তরুণ-তরুণীর আবেদনপত্র পড়ে রয়েছে। কিন্তু দল সেগুলি নিয়ে কিছু করতে পারছে না। কলকাতা জেলার সম্পাদক তথা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কল্লোল মজুমদারের কথায়, “সর্বক্ষণের কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্টিকে অনেক কিছু দেখতে হয়। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়টিও রয়েছে।”
২০১৫ সালে কলকাতায় প্লেনাম (সাংগঠনিক সম্মেলন) করেছিল সিপিএম। তার আগে এই ধরনের প্লেনাম হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। তা-ও হয়েছিল এই রাজ্যেই। হাওড়ার সালকিয়ায়। আট বছর আগের প্লেনাম থেকে সিপিএম প্রতিটি রাজ্যকে বলেছিল, ‘ক্যাডার পলিসি’ নির্দিষ্ট করতে হবে। তার মধ্যে অন্যতম বিষয় ছিল, সর্বক্ষণের কর্মীদের ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘বাস্তবসম্মত’ সিদ্ধান্ত নেওয়া। ২০১৫ সালে সিপিএমের দলিলে এ বিষয়ে ‘মডেল’ হিসাবে দেখানো হয়েছিল তেলঙ্গনা রাজ্য কমিটিকে। সেই সময়ে তেলঙ্গনা রাজ্য কমিটি তাদের রাজ্যের সমস্ত সর্বক্ষণের কর্মীকে ১৩,৫০০ টাকা করে মাসিক ভাতা দিত। এখন সেটা আরও বেড়েছে। কিন্তু বাংলায়? হুগলিতে সদ্য হোলটাইমার পান মাসিক ৫,৫০০ টকা। কলকাতায় সেটা ৭,৫০০ টাকা। উত্তর ২৪ পরগনায় ৬,৫০০ টাকা। রাজ্যে সর্বক্ষণের কর্মীদের জন্য ‘অভিন্ন’ ভাতা কাঠামোও তৈরি করতে পারেনি আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।
কেন? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের ব্যাখ্যা, “তেলঙ্গানায় দল কখনও সরকার চালায়নি। মন দিয়ে সংগঠন করেছে। কিন্তু এ রাজ্যে আমরা কেবল সরকারই চালিয়ে গিয়েছি। কর্মীনীতিতে নজর দেওয়ার সময় পাইনি। অনেকে হয়তো ভেবে নিয়েছিলেন, বাংলায় বামফ্রন্ট সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম করেছে।” অনেকের মতে, সিপিএম সরকারে থাকার সময় সর্বক্ষণের কর্মীদের অনেকের পরিবারের লোকের সরকারি চাকরি নিশ্চিত করেছিল। যা ছিল একরকমের পুষিয়ে দেওয়ার মতো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ নিয়ে সিপিএমকে প্রায়ই খোঁচা দেন। আবার এ-ও বাস্তব, অনেক সর্বক্ষণের কর্মীর দিন চলছে অনটনেই। যার জন্য তাঁরা দলের নেতাদের দূরদর্শিতার অভাবকেই দায়ী করছেন।
এই বাজারেও হোলটাইমার হওয়ার ক্ষেত্রে যাঁরা ইচ্ছাপ্রকাশ করছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে বলে সিপিএম সূত্রে খবর। তা হল, যাঁরা হোলটাইমার হতে চাইছেন, তাঁদের বেশিরভাগই শহরকেন্দ্রিক। এবং অনেকেরই পারিবারিক আর্থিক প্রতিপত্তি রয়েছে। আবার দলের অনেক প্রবীণ সর্বক্ষণের কর্মী ভাতা নিচ্ছেন না এমন উদাহরণও রয়েছে।
সিপিএম বেশ কিছু জেলায় খরচ সাশ্রয়ের পথে হাঁটছে। সম্প্রতি পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটি বেশ কয়েকটি গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। আবার হুগলি সিপিএমে নতুন একটি মহার্ঘ গাড়ি কেনা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বলে খবর। কিন্তু সার্বিক ভাবে অর্থনৈতিক কারণেই যে জেলায় জেলায় হোলটাইমার নিয়োগ বন্ধ, তা সিপিএমের নেতাদের কথাতেই স্পষ্ট।