মঙ্গলবারই ছিল এ দফায় ‘দুয়ারে সরকার’-এর প্রথম দিন। প্রতীকী ছবি।
কন্যাশ্রী থেকে লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো এক গুচ্ছ প্রকল্প আগেই ছিল। এ বার ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচিতে সাড়া মিলতে শুরু করল বিদ্যুতের বকেয়া বিল মকুবের সুবিধাতেও।
কার্যত অর্ধেক টাকা দিয়ে বিদ্যুতের বকেয়া বিল মিটিয়ে দেওয়ার এই সুযোগে শিবিরে আসা অনেকেই খুশি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এ ভাবে ঘুরপথে নিজেদের ঘাটতির বোঝা কি বণ্টন সংস্থার উপরে চাপিয়ে দিচ্ছে না রাজ্য? যা নিয়ে আগেই সতর্ক করেছে কেন্দ্র এবং রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। তা ছাড়া, যে সমস্ত গ্রাহক নিয়মিত বিল মেটান, এর পরে তাঁদের মধ্যেও তা বকেয়া রাখার প্রবণতা তৈরি হবে কি না, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে।
সম্প্রতি রাজ্যের সিদ্ধান্ত, বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ ও কৃষি ক্ষেত্রে (চাষের সাবমার্সিবল পাম্প, ডিপ টিউবওয়েল ইত্যাদি) ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বকেয়া থাকা সুদ-সমেত বিলের ৫০% মকুব করা হবে। বাদ যাবে সমস্ত রকমের সারচার্জ। বাকি ৫০% টাকা একবারে দিতে হবে গ্রাহককে।
সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। সেই দিকে তাকিয়েই এই সিদ্ধান্ত কি না, এমন প্রশ্ন উঠছে। অনেকের জিজ্ঞাসা, যাঁরা তা হলে এত দিন নিয়ম মেনে সময়ে বিদ্যুতের বিল জমা দিলেন, তাঁরা এতে বঞ্চিত হচ্ছেন না কি? সেই সঙ্গে রয়েছে বণ্টন সংস্থার ক্ষতি বৃদ্ধির ফলে তাদের আর্থিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা। যদিও দফতরের কর্তাদের একাংশের মতে, এই বকেয়া টাকা পাওয়াই যাচ্ছিল না। তাই ছাড় দিয়ে যদি কিছু টাকাও মেলে, সে ক্ষেত্রে লাভ বণ্টন সংস্থারই।
মঙ্গলবারই ছিল এ দফায় ‘দুয়ারে সরকার’-এর প্রথম দিন। বিভিন্ন জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বারও বেশি সাড়া মিলেছে লক্ষ্মীর ভান্ডার ও স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে। সরকারের দাবি, সব মিলিয়ে শিবির হয়েছে ২৭৯১টি। সেখানে এসেছেন ২ লক্ষ ৭০ হাজার ৭৩৫ জন।
রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা সূত্রে খবর, তাদের বকেয়া বিলে ছাড়ের কর্মসূচি এককালীন সুবিধা। এ দিন পূর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, উত্তর ২৪ পরগনার মতো নানা জেলায় বকেয়া বিলে ছাড়ের ওই সুবিধা নিতে অনেকে শিবিরে এসেছিলেন। পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোটের শেখ আলে নূর জানান, তাঁর সাবমার্সিবল পাম্পে সব মিলিয়ে বিল বাকি রয়েছে ১ লক্ষ ৫২ হাজার ৩৭৫ টাকা। এর মধ্যে আসল ৬০ হাজার ৯৫০ টাকা। তিনি বলেন, “আসলের অর্ধেক দিলেই বিল মকুব হয়ে যাবে শুনছি। আবেদন করলাম।’’ মালদহের চাঁচলের কলিগ্রাম বগচরা এলাকার ভাকো মহালদার পক্ষাঘাতে আক্রান্ত স্বামীকে নিয়ে শিবিরে হাজির হন বকেয়া বিদ্যুতের বিল মেটাতে। ১০৯৮ টাকা নিয়ে তাঁদের ফের বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ভাকো বলেন, ‘‘আমরা গরিব। বিল দিতে পারিনি। সরকার পাশে দাঁড়ানোয় ফের বাড়িতে আলো জ্বলবে।’’
বাঁকুড়ার খাতড়ার পিড়রাবাকড়া গ্রামের ভরত সরেন বলেন, ‘‘প্রায় পাঁচ হাজার টাকা বিল বাকি থাকায় সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছিল। শিবিরে আবেদন জানিয়ে এ দিনই খাতড়ার বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার অফিসে গিয়ে ১,৩০০ টাকা শোধ করেছি।’’ উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক শরদকুমার দ্বিবেদী বলেন, ‘‘বিলে ছাড়ের আর্জি ভালই জমা পড়েছে।’’
তবে হাওড়া, হুগলি বা মুর্শিদাবাদের মতো কিছু জেলায় এই প্রকল্পে তেমন সাড়া মেলেনি বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। মুর্শিদাবাদে ৬৮টি শিবিরে বিকেল পর্যন্ত মোট প্রায় সাড়ে ৫২ হাজার আবেদন জমা পড়লেও, তার মধ্যে বিদ্যুতের ছাড়ের আবেদন মাত্র ৯৪টি।
এ দিন দুয়ারে সরকারে সব থেকে বেশি আবেদন জমা পড়েছে বিনামূল্যে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা প্রকল্পে। হাওড়া ও হুগলির জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সেখানে শিবিরগুলিতে বেশি আগ্রহ ছিল লক্ষ্মীর ভান্ডার ও স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের আবেদনে। বীরভূমে এই দুই প্রকল্পের পাশাপাশি, বিদ্যুতের বকেয়া বিল জমার আবেদন করতেও অনেকে এসেছিলেন। বোলপুরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বনডাঙায় শিবিরে বকেয়া বিল জমা দিতে এসে বাপি বীরবংশী বলেন, ‘‘এই প্রকল্পে অনেকে উপকৃত হবেন।’’ নদিয়া জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সেখানে প্রথম দিন বেশি আবেদন জমা পড়েছে লক্ষ্মীর ভান্ডারে।
উত্তরবঙ্গের নানা জেলায় শিবিরে অবশ্য এ দিন তেমন ভিড় জমেনি। উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, শিলিগুড়ির শিবিরগুলিতে লোকজন তেমন দেখা যায়নি। আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারের শিবিরগুলিতে অন্য বারের তুলনায় ভিড় কম ছিল। তবে মালদহের গ্রামীণ এলাকার নানা শিবিরে ভিড় হয়।
জমির পাট্টা সংক্রান্ত আবেদন, কৃষি পরিকাঠামো তহবিল, মৎস্যজীবীদের নাম নথিভুক্তকরণ-সহ নতুন চারটি কর্মসূচি যোগ করে এ বার দুয়ারে সরকার শিবির শুরু হয়েছে। সেখানেই বিদ্যুতের নতুন সংযোগ ও বকেয়া বিলে আংশিক ছাড়ের আবেদনের কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বণ্টন সংস্থা জানিয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিল না মেটালে ১৫ দিনের মধ্যে তা মেটানোর নোটিস দেওয়া হয়। তারপরেও গ্রাহক তা না দিলে, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াই নিয়ম। নতুন প্রকল্পের দৌলতে অনেক গ্রাহক সেই সমস্যার মুখে পড়া থেকে রেহাই পাবেন বলে তাদের দাবি।