গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
ঘটনার দিন দুয়েক আগের কথা। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের চেস্ট মেডিসিন বিভাগের সেমিনার রুমেই রাতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সেই তরুণী চিকিৎসক। অভিযোগ, সে দিন মত্ত অবস্থায় সেখানে কেউ ঢুকে পড়েছিল। পরে মামলা চলাকালীন বিষয়টি সামনে আনেন গোলাম আজম নামে এক হাউস স্টাফ। তাঁর বয়ান থেকেই জানা যায়, সে রাতে প্রতিবাদ করে কোনও মতে রক্ষা পেয়েছিলেন তরুণী। কিন্তু তিনি বিষয়টি চেস্ট মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধানকে জানালেও কে সেই রাতে মত্ত অবস্থায় ঘরে ঢুকেছিল, তা নিয়ে কোনও তদন্ত হয়নি। ৮ অগস্ট রাতে ধর্ষণ ও খুনের শিকার হন ওই তরুণী।
গোলামের সাক্ষ্য থেকেই জানা যায়, ৮ তারিখও চেস্ট মেডিসিন বিভাগে একই রকম রহস্যজনক ব্যক্তির উপস্থিতি ছিল। আদালতের রায়ের প্রতিলিপিতে দেখা যাচ্ছে, গোলাম আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, সে রাতে প্রসিডিয়োর রুমের বেঞ্চে কেউ শুয়ে ছিলেন। গোলাম বিষয়টি জানান তরুণীকে। বাইরের লোক এ ভাবে ঢুকে এসেছে দেখে তরুণী এক মহিলা গ্রুপ-ডি কর্মীকে বলেন, ‘সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে, ওই ব্যক্তিকে চলে যেতে বলুন’। কিন্তু কে এই ব্যক্তি? সেই রাতে হাসপাতালের ভিতরে তিনি কেন ছিলেন? উত্তর নেই। তদন্তকারীরাও বিষয়টি দেখেছেন বলে উল্লেখ নেই রায়ের প্রতিলিপিতে।
সেই রাতে তরুণীর সঙ্গে খাবার খেয়েছিলেন গোলাম, অর্ক সেন, সৌমিত্র রায় এবং শুভদীপ সিংহ মহাপাত্র নামে চার চিকিৎসক পড়ুয়া। রায়ের প্রতিলিপি অনুযায়ী, গোলাম দাবি করেছেন, সপ্তাহে দু’বার হাসপাতালে রাতের ডিউটি থাকে তাঁর। ঘটনার রাতে ৯টা নাগাদ কাজে যোগ দেন তিনি। রাত ১১টা ১০ মিনিটে তাঁকে ফোন করেন প্রথম বর্ষের পিজিটি অর্ক সেন। কাজে ব্যস্ত রয়েছেন বলে তাঁকে জানান গোলাম। ১০ মিনিটের মাথায় ফের তাঁকে ফোন করেন অর্ক। খাবারের প্যাকেট এসে গিয়েছে জানিয়ে, চার তলার চেস্ট মেডিসিন বিভাগে চলে আসতে বলা হয় তাঁকে। গোলামের দাবি, সেই রাতে তরুণী নিজে খাবার অর্ডার করেছিলেন একটি অ্যাপ-নির্ভর সংস্থা থেকে। অর্কর ফোন পেয়ে একটি জলের বোতল কিনে রাত ১১টা ৪০ মিনিট নাগাদ তিনি উপরে যান। এমনিতে স্লিপ রুমে রাতের খাবার খাওয়া হয়। সেই মতো স্লিপ রুমে গেলে সেখানে কাউকেই দেখতে পাননি গোলাম। এর পরে সেমিনার রুমে খুঁজতে গিয়ে তিনি দেখেন, সেখানে তরুণীর সঙ্গেই অর্ক এবং সৌমিত্র হাজির রয়েছেন।
তরুণীর অনুরোধেই ফোন করে শুভদীপকে সেখানে গোলাম ডেকে নেন বলে তাঁর দাবি।
গোলাম জানিয়েছেন, সেমিনার রুমের ডায়াসের উপরে টেবিল-চেয়ার পেতে খাবার খেয়েছিলেন তাঁরা। ১২টা ৪৫ মিনিট নাগাদ তাঁদের খাওয়া শেষ হয়। তার আগে তাঁর ফোনেই তাঁরা অলিম্পিক্সে নীরজ চোপড়ার জ্যাভলিন থ্রো দেখেছেন। ১টা ৫ মিনিট পর্যন্ত সেমিনার রুমেই গল্প করেন এবং রাত দেড়টা নাগাদ ওয়ার্ডে ফিরে যান গোলাম। সে রাতে এক রোগীর অবস্থার অবনতি হওয়ায় গোলাম ফোন করেন অর্ককে। রোগীর আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস বা এবিজি পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দেন অর্ক। রাত ২টো ৪০ মিনিট নাগাদ অর্ক ওই পরীক্ষা করাতে ফের চার তলায় যান। ২টো ৫০ মিনিটে অর্ককে রিপোর্ট দেখাতে গোলাম সেমিনার রুমে যান বলে দাবি করেছেন। গোলাম আদালতে বলেছেন, সেমিনার রুমের দরজা ভেজানো ছিল। সেখানে অর্কের নাম ধরে ডাকলেও কেউ সাড়া দেননি। দরজার কাছে দাঁড়িয়েই তিনি দেখেছেন সেমিনার রুমের ডায়াসের উপর ম্যাট্রেস পেতে তরুণী ঘুমাচ্ছিলেন। কিন্তু সেমিনার রুমের দরজা থেকে ডায়াসের যা দূরত্ব, তাতে সেখানে দাঁড়িয়ে কেউ ঘুমাচ্ছেন দেখা সম্ভব কি না, সেই প্রশ্ন ওঠে আদালতে।
গোলাম জানিয়েছেন, স্লিপ রুমে গিয়ে তিনি অর্কের খোঁজ পান। স্লিপ রুমে সেই সময়ে অর্কের সঙ্গে সৌমিত্রও ছিলেন বলে গোলামের দাবি। অর্ক রিপোর্ট দেখে রোগীকে ছুটি দিয়ে বহির্বিভাগে দেখাতে বলার পরামর্শ দেন। এর পরে রাত সাড়ে ৩টে নাগাদ গোলাম ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে হস্টেলে চলে যান এবং সেখানে বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন অর্থাৎ ৯ অগস্ট সকালে হাসপাতাল ছাড়েন বলে দাবি করেছেন। ওই দিনই বেলার দিকে ফোনে তিনি জানতে পারেন, আর জি করের এক চিকিৎসক ‘আত্মহত্যা’ করেছেন।
সাক্ষ্য দেওয়ার সময় অর্ক দাবি করেছেন, ওই রাতে ১১টা ১৫ মিনিটের আগেই খাবার চলে আসে। রাত ১টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত খাওয়া চলে তাঁদের। এরপর তিনি স্লিপ রুমে এক জন রোগীকে দেখার জন্য চলে গিয়েছিলেন। রাত ২টো বা ২টো ১৫ মিনিট নাগাদ তিনি ফের সেমিনার রুমে গিয়েছিলেন বলে অর্ক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। সেই সময়ে তিনি নিজের ফেলে আসা ব্যাগ সেখান থেকে আনতে গিয়েছিলেন বলে দাবি তাঁর। ব্যাগ নিয়ে ফিরে তিনি সৌমিত্রকে ফোনে ডেকে নেন এবং দু’জনেই স্লিপ রুমে কাটান বলে দাবি করেছেন।
অর্কের দাবি, সকালে ৯টা বেজে গেলেও তরুণী ডিউটিতে যোগ দিতে আসছেন না দেখে সৌমিত্র তাঁকে জানান, তরুণীকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। অর্ক নিজেও ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন এবং না পেয়ে একাই সেমিনার রুমে দেখতে যান বলে দাবি করেছেন। সেই সময়ই তরুণীর রক্তাক্ত, অর্ধনগ্ন মৃতদেহ দেখে নার্সিং স্টেশনে ছুটে এসে তিনি বাকিদের জানান। অর্ক দাবি করেছেন, সেই রাতে যখন তিনি সেমিনার রুমে যান, তরুণী লাল রঙের কম্বল জড়িয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। কপালের উপরে, মাথার কাছেই রাখা ছিল তাঁর হাত।
আদালতে কথা ওঠে, অর্কের ব্যাগ আনতে যাওয়ার তত্ত্ব খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ তিনিই প্রথম মৃতদেহ দেখে এসে সবাইকে জানিয়েছিলেন। প্রশ্ন ওঠে, অগস্ট মাসের গরমে তরুণী কেন কম্বল জড়িয়ে ঘুমাবেন? প্রশ্ন ওঠে গোলাম এবং অর্কের দেওয়া ঘটনাপ্রবাহের সময় সারণি তো মিলছে না! অর্ডার করা খাবার যিনি পৌঁছে দিয়ে গেলেন, তিনি কে? কেন তাঁকে খুঁজে বার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল না? কেন খাবারের প্যাকেটই বা পাওয়া গেল না? আদালতে এ-ও প্রশ্ন উঠেছে, যে চার জন চিকিৎসক-পড়ুয়া সেই রাতে ঘটনাস্থলে ছিলেন, তাঁদের সবার কেন সাক্ষ্যগ্রহণ করা হল না?
রায়ের প্রতিলিপিতে বিচারক লিখেছেন, এটা ধর্ষণ, খুনের ঘটনা। কিছু খাইয়ে দিয়ে অচৈতন্য করার বা খাবার খাওয়া সম্পর্কিত অন্য কোনও তথ্যপ্রমাণ এই মামলায় উঠে আসেনি।