যেতে দেবো না। বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা স্বাতী মুখোপাধ্যায়কে ঘিরে ছাত্রীরা। সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
সাদা কাগজে কাঁচা হাতে লেখা: ‘আমাদের ছেড়ে যাবেন না, বড়দি।’ সেই কাগজ নিয়ে কচিমুখগুলো দাঁড়িয়ে প্রধান শিক্ষিকার ঘরের সামনে।
পড়ুয়াদের পিছনে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে স্কুলের অন্য দিদিমণিরা। বড়দির চলে যাওয়া আটকাতে স্কুলে চলে এসেছেন পরিচালন সমিতির সদস্য, এমনকী সভাপতিও। স্কুলের এক ছাত্রীর অভিভাবকও সামনে এসে বললেন, ‘‘বড়দি, আপনি চলে যাবেন শুনে মেয়েটা খুব কাঁদছে। থেকে যান না।’’
ভালবাসার এই আবদারে কার্যত সারাদিন ঘেরাও হয়ে রইলেন উত্তর ২৪ পরগনার বেড়াচাঁপার বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা স্বাতী মুখোপাধ্যায়। ২৮ বছর আগে যিনি এই স্কুলে পড়াতে শুরু করেছিলেন।
কিছু চাকরিতে বদলি হয় রুটিন মাফিক। তেমন চাকরিতেও বিডিও, চিকিৎসক, এমনকী প্রিয় পুলিশ অফিসারের বদলি ঠেকাতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখেছেন রাজ্যের মানুষ। ১৯৯৪ সালে তারাপীঠের কাছে তারাপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক অভিজিৎ রায়চৌধুরীর বদলি আটকাতে পথে নেমেছিলেন এলাকাবাসী। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ গুলি চালায়। তাতে মারা যান তিন জন।
স্কুলের চাকরিতে অবশ্য রুটিন বদলি নেই। অনেক সময়েই বাড়ির কাছাকাছি কাজ করার জন্য ‘মিউচুয়াল ট্রান্সফার’ নিয়ে থাকেন শিক্ষকেরা। বারাসতের বাসিন্দা স্বাতীদেবীও বাড়ির কাছাকাছি কাজ করতে চেয়ে বদলি নিয়েছিলেন নিমতার জীবনতোষ ঘোষ মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ে। এ রকম বদলি আগেও অনেক হয়েছে। কিন্তু তাঁর এই চলে যাওয়া আটকাতে ছাত্রী, শিক্ষিকা, পরিচালন সমিতির সদস্য-সহ গোটা এলাকার মানুষ যে এ ভাবে পথে নেমে পড়বে, তা ভাবতে পারেননি তিনি।
ছাত্রী-সহকর্মীদের কান্না, পরিচালন সমিতি ও এলাকার মানুষের আবেদনে অবশ্য শেষপর্যন্ত হার মেনেছেন স্বাতীদেবী। চশমা খুলে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টানোর কথা জানিয়েছেন। জানিয়েছেন, বদলি বাতিলের জন্য আবেদন জানাবেন শিক্ষা সংসদের কাছে। হাসি ফুটেছে ঘেরাওকারী কচিমুখগুলোতে।
কেন বড়দির বদলি আটকাতে চান সবাই? নাজমা খাতুন নামে এক ছাত্রীর কথায়, ‘‘শুধু পড়াশোনা নয়, উনি আমাদের বাড়ির সব খবর রাখতেন। কেউ মন খারাপ করে থাকলে ডেকে খোঁজ নিতেন।’’ স্কুলের এক শিক্ষিকা সুমিতা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শুধু ছাত্রীদের নয়, উনি সবার বন্ধু, অভিভাবক। কী করে স্কুলের ভাল হবে, তা নিয়েই সব সময় ভাবেন।’’ অন্য দিদিমণিরাও জানান, স্কুলে ৭ জন শিক্ষিকার পদ খালি। কিন্তু বড়দিই সব দিক সামাল দিতেন। পরিচালন সমিতির সভাপতি শান্তনু মণ্ডল জানান, স্বাতীদেবীর মা-ও এই স্কুলেরই শিক্ষিকা ছিলেন। বড়দিও এই স্কুলের ছাত্রী। ২৮ বছরের চাকরির শেষ ১২ বছর প্রধান শিক্ষিকার পদে রয়েছেন তিনি। তাঁর উদ্যোগে চালু হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক, স্কুল বাড়িটিও চারতলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘উনি ছাড়া এই স্কুলের কথা ভাবাই যায় না। ওঁকে আটকাতে দরকার হলে আমরা শিক্ষামন্ত্রীর কাছেও যাব।’’
কী বলছেন বড়দি? বুধবার বাড়িতে বসে স্বাতীদেবী বলেন, ‘‘যাতায়াতের অসুবিধার জন্য কাছাকাছি বদলি চেয়েছিলাম। কিন্তু এলাকার মানুষ ও ছাত্রীরা যে এ ভাবে আটকে দেবেন, তা ভাবতেও পারিনি! এদের নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।’’