প্রতীকী চিত্র
জঙ্গলে খাবারের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরতে হচ্ছে না। মহানগরী-সহ সর্বত্র লোকালয়েই শিকার ধরার জন্য ওত পেতে বসে রয়েছে অতিমারির বাঘ। তার সামনে উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা জনতা! যাদের ভয়ডরের বালাই নেই। আত্মসুখের বিলাসিতায় যে-ভিড় সাক্ষাৎ-শমনের সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি বা নিজস্বী তুলতে ব্যস্ত।
করোনার বিপদকে ব্যাখ্যা করার জন্য চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞদের একাংশ যে এমন বাঘা রূপকের আশ্রয় নিচ্ছেন, তার কারণ স্পষ্ট। দেবীপক্ষ শুরুর আগে রাজ্যে সংক্রমণের পজিটিভিটি রেট ছিল ১.৩৬। পুজোর ভিড়ের ধাক্কায় ঊর্ধ্বমুখী হয়ে দ্বিতীয়ায় তা পৌঁছে গিয়েছিল ২.৩৪-এ। মহাষ্টমীতে সেটি হয় ২.৭৪। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, মহানবমীতে সেই পজিটিভিটি রেট বেড়ে হয়েছে ২.৯৩। অর্থাৎ সংক্রমণ-হারের পারদ চড় চড় করে বেড়েই চলেছে।
বঙ্গের আকাশে অতিমারির তৃতীয় ঢেউয়ের মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে। অথচ হাজারো আবেদন-নিবেদন, সতর্কতার প্রচার সত্ত্বেও ভ্রুক্ষেপ নেই জনতার। পুজো মণ্ডপের বাইরে কোভিড বিধিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া মানুষের ঢল দেখে চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, "ক্ষিপ্ত বাঘের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে সে কি শিকার ছেড়ে দেবে? তা তো হয় না। ঠিক তেমনই মাস্ক খুলে, দূরত্ব-বিধি শিকেয় তুলে যে-ভিড় প্যান্ডেল হপিংয়ের আনন্দে মাতোয়ারা, তাদের ছেড়ে দেবে না ভাইরাস। সে ওত পেতেই আছে। ফের কোভিড ভাইরাসের আঘাত করার আশঙ্কাই সর্বাধিক। তাতে কেউ হয়তো বেশি জখম হবেন, কেউ কম।"
চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, অসতর্কতার মনোভাব অবিলম্বে বদলে ফেলতে না-পারলে সামনের একটি-দু’টি মাস শুধু আমজনতা নয়, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের পক্ষেও খুব কঠিন সময় হয়ে উঠতে চলেছে। তাই নবমী নিশি পেরিয়ে আজ, শুক্রবার দশমীতে বিসর্জনের উচ্ছ্বাসে লাগাম টানার ডাক দিচ্ছে স্বাস্থ্য শিবির।
স্বাস্থ্য দফতরের বৃহস্পতিবার বুলেটিন অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫৩০ জন। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সংক্রমণ আচমকা ৭০০-র ঘর থেকে ৫০০-র ঘরে নেমে আসায় উচ্ছ্বাসের বা আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই। কারণ, এর মানে এই নয় যে, করোনা সংক্রমণ কমে গিয়েছে। আসলে পুজোর মরসুম এবং করোনা পরীক্ষায় অনীহার কারণেই সংখ্যাটি কম দেখাচ্ছে। রাজ্যে যেখানে দৈনিক পরীক্ষা ৫০ হাজারের ঘরে থাকত, সেটি এই ক’দিনে ২০ বা ১৮ হাজারের ঘরে ঘোরাফেরা করছে। তাতেই অশনি সঙ্কেত স্পষ্ট। এক চিকিৎসক বলেন, "বাড়াবাড়ি না-হলে বোধ হয় এক শ্রেণির মানুষের শিক্ষা হয় না। মৃদু উপসর্গের লোকজন পরীক্ষা করাতে চাইছেন না। তাঁরা নিজেরাই ভেবে নিচ্ছেন, সেটি সাধারণ ঠান্ডা-গরম আবহাওয়ার ফল। কিন্তু এই আত্মবিশ্বাস আদতে করোনাকে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সহযোগিতা করছে।"
কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্কের সদস্য, শল্যচিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার বলেন, ‘‘চার-পাঁচ দিনের মধ্যে পজিটিভিটি রেট এক শতাংশ বেড়ে ঈশান কোণে অশনি সঙ্কেত দিচ্ছে। তা সত্ত্বেও কিছু মানুষ অবৈজ্ঞানিক ভাবে কোভিড বিধির প্রতি অনীহা দেখিয়ে আত্মঘাতের দিকে এগিয়ে চলেছেন। এটাই মারাত্মক।’’ চিকিৎসক ও সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের একাংশের আশঙ্কা, অঘটন যা ঘটার, তা হয়তো ইতিমধ্যেই ঘটে গিয়েছে। এখন দেখার, প্রাণহানি যেন না-বাড়ে। তাঁরা এখনও মানুষের শুভবুদ্ধির উপরে আস্থা রাখতে চাইছেন। এর পরে আছে লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো। পজিটিভিটি রেট বৃদ্ধির দিকে লক্ষ রেখে উৎসবের পরবর্তী পর্যায়ে সংযত আচরণ করার আবেদন জানাচ্ছে স্বাস্থ্য শিবির।
মহাষ্টমীর রাতের আচমকা বৃষ্টিতে কিঞ্চিৎ স্বস্তি অনুভব করছিলেন চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁরা আশা করছিলেন, যাক, এ বার অন্তত রাস্তার ভিড় কিছুটা কমবে। কিন্তু কোথায় কী! বৃষ্টি এড়াতে নবমীর সকাল থেকেই রাস্তায় নেমে পড়ে জনতা। দুপুর-বিকেলেই রাস্তায় থিকথিকে ভিড়। লেক টাউনের একটি পুজোয় দর্শকের প্রবেশ বন্ধ হতেই ভিড় ছুটেছে উত্তর-দক্ষিণে। এক সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘‘বিজ্ঞান তো এলাকা-ভেদে বদলে যায় না। করোনা ভাইরাস সর্বত্র একই ভাবে প্রভাব ফেলছে। এই ভাইরাস সুযোগসন্ধানী। ভিড়, মাস্কহীন পরিবেশের সুযোগে থাকে দ্রুত সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতাধর এই ভাইরাস। এ বারের পুজো তাদের বড় সুযোগ করে দিল। লাভ-ক্ষতির হিসেবটা পুরোপুরি বুঝতে আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে।’’
জনস্বাস্থ্যের দিক থেকেও এ বারের পুজোর ভিড় মারাত্মক ক্ষতি করে দিল বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অব ডক্টর্স, ওয়েস্ট বেঙ্গলের চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, আত্মঘাতী হওয়ার পথ থেকে, প্রিয়জনকে বিপদে ফেলা ও প্রিয়জনকে চিরবিচ্ছেদের পথ দেখানো থেকে মানুষকে বিরত থাকতে হবে। যদিও অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। তবু পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগে মানুষকে সংযত হওয়ার ডাক দিচ্ছেন তাঁরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই জানান, কোভিড সতর্কতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সব কিছু ভুলে মানুষ যে-ভাবে রাস্তায় নেমেছেন, স্বাস্থ্য দফতরের কাছে সেটা অশনি সঙ্কেত। সাধারণ নাগরিক ও পুজোর উদ্যোক্তাদের কাছে আর একটু বেশি দায়িত্বজ্ঞান আশা করেছিলেন চিকিৎসকেরা। এখন প্রশাসনকে আরও নিবিড় প্রচার চালাতে হবে, প্রয়োজনে হতে হবে অধিকতর কঠোর। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অনির্বাণবাবু বলেন, ‘‘মানুষের কাছে আমাদের আর্জি, এখনও যেটুকু সময় আছে, সতর্ক হোন। কোভিড বিধি মানুন। যত দ্রুত সম্ভব টিকার দু’টি ডোজ় নিয়ে নিন। এবং উপসর্গ দেখা দিলে বিন্দুমাত্র বিলম্ব না-করে পরীক্ষা করান, চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।’’