কে কী করছে বা বলছে, সেটা বড় কথা নয়। নারদ স্টিং অপারেশন নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চ যে-রায় দেবে, সেটাই শেষ কথা বলে এর আগে সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর।
বুধবার প্রধান বিচারপতি আরও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন, নারদ-মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকাকালীন সেই ব্যাপারে কোনও ধরনের পৃথক তদন্ত করা উচিত নয়।
প্রধান বিচারপতির এ দিনের মন্তব্য মোটেই চূড়ান্ত রায় নয়। তবে এর পরে স্টিং অপারেশন নিয়ে পুলিশি তদন্তের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে, সেই বিষয়ে জোর জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে আইনজীবী শিবিরে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে নারদের হুল অভিযান নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে কলকাতা পুলিশ। লালবাজারের তদন্তকারীরা নারদ নিউজের কর্ণধার ম্যাথু স্যামুয়েলকে একাধিক বার নোটিস পাঠিয়ে তাঁদের সামনে হাজির হতে বলেছেন। কিন্তু ম্যাথু এখনও তদন্তকারীদের মুখোমুখি হননি। লালবাজারের পাঠানো ই-মেলের জবাবে পাল্টা ই-মেল পাঠিয়ে তিনি জানান, হাইকোর্টই তো এই মামলায় শেষ কথা বলবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। সেখানে বিচার চলাকালে পুলিশ তাঁকে তলব করতে পারে না বলে ম্যাথুর অভিমত। এমনকী তলবি ই-মেল প্রত্যাহারের পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি।
নারদ-প্রধানকে কব্জায় পেতে অবশেষে নিম্ন আদালতের দ্বারস্থ হয় লালবাজার। তিনি যাতে লালবাজারে হাজিরা দিয়ে তদন্তকারীদের প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য হন, তার নির্দেশ দেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন জানায় পুলিশ। সেই আর্জি মঞ্জুর করে নোটিস জারি করে নিম্ন আদালত। তদন্তকারীরা সেই নোটিস-সহ নতুন তলবি বার্তা পাঠায় ম্যাথুর কাছে। গ্রেফতারির আঁচ পেয়ে নারদ-কর্ণধার দ্বারস্থ হন উচ্চ আদালতের।
২৫ জুলাই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি চেল্লুর ও বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বে়ঞ্চে হাজির হন ম্যাথুর আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ। তিনি আদালতে জানান, তাঁর মক্কেলের আশঙ্কা, লালবাজারে তদন্তকারীদের সামনে হাজির হলেই তাঁকে গ্রেফতার করা হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে তিনি হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ চান। প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ অরুণাভবাবুকে এই ব্যাপারে তাঁর মক্কেলের লিখিত আবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
বিধানসভা ভোটের মুখে শাসক দলের বিভিন্ন নেতানেত্রী দেদার টাকা নিচ্ছেন, ভিডিওয় তোলা এমন ছবি দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ম্যাথুর নারদ নিউজ। সেই ভিডিও ফুটেজ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-সহ সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। ওই ফুটেজের সত্যতা এখনও প্রমাণিত হয়নি। তবে নির্বাচনের মুখে মোক্ষম হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে ভেবে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল বিরোধী শিবির। হুল-বিদ্ধ নেতানেত্রীদের আদৌ নির্বাচনে প্রার্থী হতে দেওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে শুরু হয়ে যায় তরজা। সেই ভিডিও নিয়ে হাইকোর্টে মামলা চলছে। পরীক্ষার জন্য ওই ফুটেজ প্রথমে হায়দরাবাদের ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি এবং পরে চণ্ডীগড়ের ফরেন্সিক বিভাগে পাঠানোর নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের বিচারাধীন বিষয়ে সরকার নতুন করে তদন্ত চালাতে পারে কি না, প্রশ্ন উঠেছিল তখনই। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়েছিল, কে কী করছে বা বলছে, সেটা বিবেচ্য নয়। শেষ কথা বলবে আদালতই। তাতে কারও আপত্তি থাকলে আদালতের দরজা খোলাই আছে।
নারদ স্টিং অপারেশন নিয়ে দায়ের হওয়া তিনটি জনস্বার্থ মামলার নিষ্পত্তি হয়নি এখনও। মামলাগুলি হাইকোর্টের বিচারাধীন। স্টিং অপারেশনের ভিডিও ফুটেজের সত্যতা যাচাই করার জন্য সেটি চণ্ডীগড়ের ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হলেও সেই পরীক্ষার রিপোর্ট এখনও এসে পৌঁছয়নি। নারদ-প্রধানের লিখিত আবেদনও জমা পড়েনি হাইকোর্টে। ম্যাথুর আইনজীবী অরুণাভবাবু এ দিন আদালতে জানান, তাঁর মক্কেল এখন বিদেশে। লিখিত আবেদনে তাঁর সই থাকা প্রয়োজন। সই করা সেই আবেদনপত্র কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনায় তাঁর হাতে পৌঁছলেই তিনি সেটি আদালতে পেশ করবেন।
রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) জয়ন্ত মিত্র হাইকোর্টে উপস্থিত ছিলেন। অরুণাভবাবুর বক্তব্য শুনে প্রধান বিচারপতি এজি-র উদ্দেশে বলেন, ‘‘মামলাটি যখন আদালতে বিচারাধীন, তখন এই ব্যাপারে অন্য তদন্ত চলা উচিত নয়।’’ জয়ন্তবাবু জানান, স্টিং অপারেশন নিয়ে লালবাজার যা করছে, সেটা আদৌ পৃথক তদন্ত কি না, সেই ব্যাপারে আদালতে সওয়াল করবে সরকার।