গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
কয়েক বছর আগে থেকে গোটা ভারতেই বার্তাটা চারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। অস্পৃশ্যতা আর বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আরএসএস-বিজেপি কতটা ‘সক্রিয়’, নানা ভাবে তা বোঝানোর চেষ্টা চলছে। এ বার আলাদা গুরুত্বের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে সেই ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টায় সঙ্ঘ পরিবার। কখনও মন্দিরে ‘দাস’ পদবিধারীদের ঢুকতে না-দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কখনও রাঢ়বঙ্গ এবং জঙ্গলমহলের জনজাতি গ্রামে ‘গোগো পূজন’। কখনও বাংলার জনজাতি প্রধান গ্রামে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) আন্তর্জাতিক সভাপতির আগমন। এ সবই সেই প্রচেষ্টার নানা রূপ। দেশের অন্য অনেক রাজ্যে বর্ণবৈষম্যের প্রকোপ যতটা, বঙ্গে দৃশ্যত তার চেয়ে কম। অস্পৃশ্যতার ক্ষেত্রেও বাংলা তুলনামূলক ভাবে কম উগ্র। এ হেন রাজ্যে ‘সামাজিক সাম্য’ নিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের বাড়তি সক্রিয়তার কারণ কী? লক্ষ্য শুধু সমাজ সংস্কার? না কি নজরে হিন্দু ভোটের একত্রীকরণও? চর্চা নানা মহলে।
গীধেশ্বরের মন্দিরের ঘটনা এবং আরএসএস
পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া মহকুমার গীধ গ্রামে সাড়ে ৩০০ বছরের শিবমন্দির। গ্রামের দাস পদবিধারীদের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না কয়েক দিন আগে পর্যন্ত। পূর্বতন জমিদার বংশের তৈরি করা গীধেশ্বর মন্দিরে গ্রামেরই এক ব্রাহ্মণ পরিবার বংশপরম্পরায় পুজো করে আসছে। জমিদারি জমানাতেই মন্দিরের আরও কিছু কাজ নির্দিষ্ট করা হয়েছিল ঘোষ, মালাকার, কুম্ভকার, হাজরা-সহ নানা পদবির জন্যও। কিন্তু দাসেদের জন্য কোনও কাজ নির্দিষ্ট করা হয়নি। বরং মন্দিরে তাঁদের প্রবেশই নিষিদ্ধ রাখা হয়েছিল। গীধে দাসেরা ১৩০ ঘর। মন্দিরে প্রবেশাধিকার চেয়ে এ বছর শিবরাত্রির আগে তাঁরা কাটোয়ার মহকুমাশাসকের দ্বারস্থ হন। জনপ্রতিনিধি, মন্দির কমিটি, গ্রামবাসীদের প্রতিনিধি-সহ নানা পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসে প্রশাসন সমস্যা মেটাতে উদ্যোগী হয়। সহজে হয়নি। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে গ্রামে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। দফায় দফায় পুলিশও মোতায়েন করতে হয়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই গোটা পর্বে আরএসএস বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সওয়াল করতে শুরু করে। সঙ্ঘের পূর্ব ভারত ক্ষেত্রের সহ-প্রচার প্রমুখ জিষ্ণু বসু, মধ্যবঙ্গ প্রান্তের প্রচার প্রমুখ সুশোভন মুখোপাধ্যায়-সহ অনেকে সরব হতে থাকেন সমাজমাধ্যমে। আরএসএসের তৃতীয় সরসঙ্ঘচালক মধুকর দত্তাত্রেয় দেওরস বলতেন, ‘‘অস্পৃশ্যতা যদি পাপ না-হয়, তা হলে পৃথিবীতে পাপ বলে কিছু নেই।’’ জিষ্ণু, সুশোভনেরা সেই মন্তব্য তুলে ধরে গীধেশ্বরের মন্দিরে দাসেদের প্রবেশাধিকারের পক্ষে সওয়াল করতে শুরু করেন।
গীধ গ্রামে প্রতিবাদটা আরএসএস শুরু করেনি। দাসেদের মধ্যে থেকেই প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল। সমস্যার নিরসনে সক্রিয় হয়েছিল রাজ্যের প্রশাসন। কেন স্বাধীনতার এত দিন পরেও এই অস্পৃশ্যতা রয়েছে, তা নিয়ে প্রশাসনকে মৃদু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করানোর চেষ্টা আরএসএস পদাধিকারীরা করেছিলেন। কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। বরং কাটোয়ায় প্রশাসনিক উদ্যোগকে পরোক্ষে সমর্থনই জানিয়ে গিয়েছে এ রাজ্যের সঙ্ঘ।
গোগো পূজন
জনজাতি সমাজের ভাষায় ‘গোগো’ শব্দের অর্থ ‘মাতা’। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) গত দু’সপ্তাহ ধরে রাঢ়বঙ্গ এবং জঙ্গলমহলের বেশ কিছু জনজাতি গ্রামে এই ‘মাতা পূজন’ শুরু করেছে। গ্রামে গ্রামে জনজাতি মহিলাদের একত্রে এনে তাঁদের পূজা করা হচ্ছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক রাজ্য স্তরের পদাধিকারীর কথায়, ‘‘যে মন্দিরে সাঁওতাল মায়েরা ঢুকতে পারতেন না, সেই মন্দিরের পুরোহিত গ্রামে গিয়ে ওই মায়েদের পা ধুয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের পুজো করছেন। সঙ্গে সমাজের বিশিষ্টজনেরা থাকছেন। সবাই মিলে মায়েদের সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন। হিন্দু সমাজে তাঁদেরকে কারও থেকে নিচু হিসেবে যে দেখা হয় না, সে বোধ বনবাসী সমাজে তৈরি হচ্ছে।’’
জনজাতি নেতৃত্ব
এপ্রিলে ভিএইচপির আন্তর্জাতিক সভাপতি অলোক কুমার দু’দিনের সফরে পশ্চিমবঙ্গে আসছেন। দিল্লি বিধানসভার প্রাক্তন ডেপুটি স্পিকার অলোক ১৯ এপ্রিল যাচ্ছেন বীরভূমে। একটি জনজাতি প্রধান এলাকায় তাঁর কর্মসূচি রাখা হচ্ছে। সংগঠনের এ রাজ্যের নেতৃত্ব বলছেন, ‘‘বনবাসী সমাজের মধ্যে আমাদের সামাজিক সমরসতা আয়াম এবং ধর্মপ্রসার আয়াম কাজ করছে। সেই সংক্রান্ত কর্মসূচিতেই আমাদের আন্তর্জাতিক সভাপতি যোগ দেবেন।’’ জনজাতি সমাজে ধর্মান্তরণ রোখা এবং ধর্মান্তরিতদের হিন্দুত্বে ফেরানোর কাজ করে ভিএইচপির ‘ধর্মপ্রসার আয়াম’। বীরভূমে কি সে রকম কোনও কর্মসূচি? ভিএইচপি সূত্রের খবর, কাউকে হিন্দুত্বে ফেরানোর কর্মসূচি নিয়ে এ বার অলোক আসছেন না। তবে জনজাতি সমাজ থেকেই এমন নেতৃত্ব তুলে আনার চেষ্টা হচ্ছে, যাতে তাঁদের প্রভাবেই ভবিষ্যতে ধর্মান্তরণ আটকে যায়।
ঘটনাচক্রে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার দেশের রাষ্ট্রপতি ভবনেই জনজাতি নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় প্রতীক তৈরি করেছে। জনজাতি মহিলা দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদে বসানো হয়েছে। তাঁর পূর্বসূরি রামনাথ কোবিন্দ ছিলেন দলিত সমাজের প্রতিনিধি। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে ওবিসি সমাজ থেকে এসেছেন। সেই প্রধানমন্ত্রী আবার ২০১৯ সালে কুম্ভস্নান সেরে প্রয়াগরাজে দলিত সাফাইকর্মীদের পা ধুয়ে দিয়েছিলেন নিজের হাতে। দীর্ঘ কাল ধরেই আরএসএস-বিজেপি তথা গোটা সঙ্ঘ পরিবার বর্ণবৈষম্য বিরোধী ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা কোমর বেঁধে শুরু করেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে বিশেষ ভাবে সেই কাজে জোর দেওয়া কেন? লক্ষ্য কি ২০২৬? রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র তথা সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘এর সঙ্গে ভোটের কোনও সম্পর্ক নেই। প্রথমত, আমরা সমস্ত দেহ-মন দিয়ে অস্পৃশ্যতা এবং বর্ণবৈষম্যকে ঘৃণা করি। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুর অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে গোটা হিন্দু সমাজের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যেই যা হওয়ার হচ্ছে। ভোট গৌণ।’’
ইতিহাস বলছে, অষ্টাদশ শতকের আমেরিকায় এই ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ’ গড়ার কৌশল নেওয়া হয়েছিল। আমেরিকার গৃহযুদ্ধে জনসংখ্যার বিরাট অংশ সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়। তাঁদের মধ্যে অনেকে যুদ্ধফেরত প্রবীণ। অনেকে যুদ্ধে নিহতদের পরিজন। এঁদের মধ্যে সমাজের মূল স্রোতে থাকার অনুভূতি তৈরি করতে ‘বৈচিত্র, অংশীদারি এবং অন্তর্ভুক্তি’-র (ডাইভার্সিটি, ইক্যুইটি, ইনক্লুশন বা ডিইআই) নীতি নেওয়া হয়েছিল। আমেরিকায় বসবাসকারী সব জাতিগোষ্ঠীই মূল স্রোতের অংশ, সকলের সমান অধিকার এবং কেউ ব্রাত্য নন— এই বার্তা দেওয়ারই চেষ্টা হয়েছিল। সেই ‘ডিইআই নীতি’র সাফল্য আমেরিকা কতটা পেয়েছে, ইতিহাস তার সাক্ষী। আজকের আমেরিকাতেও সেই ‘ডিইআই নীতি’ জনপ্রিয় সামাজিক ও প্রশাসনিক কৌশল।
ভারতে সঙ্ঘ পরিবারও কি সেই নীতি প্রয়োগের চেষ্টা করছে? ভারতের জনসংখ্যার সিংহভাগই দলিত, অনগ্রসর ও জনজাতি। মতাদর্শগত লড়াইয়ে দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য পেতে হলে সমাজের সেই বিরাট অংশের মনে যে স্থায়ী ভাবে ছাপ ফেলতে হবে, তা আরএসএসের অজানা নয়। সেই কারণেই কি গৃহযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকার ‘ডিইআই নীতি’-র ছাপ সঙ্ঘ পরিবারের গতিবিধিতেও? পশ্চিমবঙ্গে কি তা আরও জরুরি সামনে ভোট বলে? বিজেপি-আরএসএস প্রায় এক সুরে দাবি করছে, ভোটের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।