ভারত এক জন দরদি প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে, যিনি স্কুলপড়ুয়াদের ওজনবৃদ্ধির সমস্যা নিয়ে চিন্তিত। ‘পরীক্ষা পে চর্চা’ ও ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে তিনি সেই উৎকণ্ঠা প্রকাশও করেছেন, সমীক্ষা উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন তথ্য: সাম্প্রতিক হিসাবে স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে এক কোটি ২৯ লক্ষ পড়ুয়া বেশি ওজনের সমস্যায় ভুগছে। এখনকার খাদ্যাভ্যাস ও জীবনচর্যার অসঙ্গতিই ওজন বৃদ্ধির কারণ, তাই প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগের জেরে কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রক নির্দেশিকা জারি করেছে, এখন থেকে সরকারি ও সরকার-পোষিত স্কুলে মিড-ডে মিল রান্নায় ভোজ্য তেলের ব্যবহার ১০ শতাংশ কমাতে হবে। স্কুলে মিড-ডে মিল রাঁধুনি ও কর্মীদের তেল কমানোর প্রশিক্ষণ দিতে হবে, রান্নায় তেল কমানো নিয়ে স্কুলে করাতে হবে ‘স্পেশাল ক্লাস’, পুষ্টিবিদদের ডেকে এনে বোঝাতে হবে কম তেলযুক্ত খাবারের উপযোগিতা, স্কুলপড়ুয়াদের পাতে তেলযুক্ত রান্নার পরিবর্তে সেদ্ধ, গ্রিল, স্টিম বা বেক করা খাবার এবং ফল শাক-আনাজ দানাশস্যসমৃদ্ধ খাদ্যের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
অনুমান করা যায়, এই নির্দেশিকা ইতিমধ্যে সরকারি স্কুলে স্কুলে পৌঁছে গেছে। তাতে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষক-অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া কী, তা অনুমান করতে ভয় হয়। তার কারণটি অজানা নয়। এ দেশে মিড-ডে মিলের জন্য সরকার যে অর্থবরাদ্দ করে থাকে তা এতই যৎসামান্য যে, তার পাশে এই নির্দেশিকা শোনাবে নিষ্ঠুর উপহাসের মতো। প্রাথমিকে মিড-ডে মিলে মাথাপিছু ৬ টাকা ১৯ পয়সা, উচ্চ প্রাথমিকে ৯ টাকা ২৯ পয়সা সরকারি বরাদ্দে স্কুলপড়ুয়াদের পাতে এমন কী জুটতে পারে, যাতে তাদের ন্যূনতম পুষ্টির চাহিদাটুকু পূরণ করা যায়? কেন্দ্রীয় সরকারের তালিকায় প্রাথমিকের পড়ুয়াদের মিড-ডে মিলে প্রোটিন দেওয়ার কথা বলা আছে ১২ গ্রাম, ডাল ২০ গ্রাম— সবচেয়ে বড় কথা, যে তেলের ব্যবহার কমানো নিয়ে এত কিছু, সেই তেলজাতীয় পদার্থ ব্যবহারের কথা বলা আছে মাত্র ৫ গ্রাম। উচ্চ প্রাথমিকে এই মাত্রা যৎসামান্য বেশি। পশ্চিমবঙ্গে সরকার-পোষিত স্কুলগুলি মিড-ডে মিলে গোটা সপ্তাহে এক দিন ডিম, এক দিন সয়াবিন এবং কোনও দিন ডাল, খিচুড়ি, তরকারিটুকুই কুলিয়ে উঠতে পারে না; সরকারি স্কুলে লক্ষ লক্ষ পড়ুয়া অপুষ্টির শিকার, এটিই আসল সত্য। একটি শিশুর ৫ গ্রাম বরাদ্দ তেল থেকে আরও ১০ শতাংশ কমিয়ে দিলে কোন নির্মম সত্যটুকু পাতে পড়ে থাকে, সেই অঙ্কটি প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর শিক্ষা দফতর স্কুলপড়ুয়াদের সামনে এসে কষতে পারবেন তো?
স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে বেশি ওজন বা ‘ওবিসিটি’র সমস্যা অমূলক নয়। কিন্তু গ্রামে না শহরে, বা কোন আর্থ-সামাজিক স্তরে সেই সমস্যা নিহিত, তা শনাক্ত করার কোনও রকম চেষ্টা না করে গোটা দেশের সমস্ত সরকারি স্কুলপড়ুয়াদের জন্য ঢালাও নির্দেশিকা জারি করে যে কাজের কাজ কিছু হবে না, তা কি কেন্দ্র বুঝতে পারছে না? অপুষ্টি বা ন্যূনতম পুষ্টির প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের জন্য স্কুলের খাবারে ওজন কমানোর দাওয়াই অমানবিক; ডাল-ভাতের সংস্থান যার হবে কি না ঠিক নেই, তার সামনে গ্রিল বা বেক করা খাবারের উল্লেখমাত্রও অশ্লীল। ভারতে এই ২০২৫ সালেও লক্ষ লক্ষ শিশুকে স্কুলে পাঠানো হয় কেবল তার এক বেলার অন্নসংস্থানটুকু বিনা পয়সায় হয়ে যাবে বলে— এই কথাটি প্রধানমন্ত্রীকে কেউ বলতে পারেন না?