অনেক প্রত্যাশা নিয়ে আশা, আইসিডিএস, মিড-ডে মিল কর্মীরা অপেক্ষা করেছিলেন যে, রাজ্য বাজেটে হয়তো কিছু একটা হবে তাঁদের জন্য। কেন্দ্রীয় বাজেটে এঁদের জন্য কিছুই বরাদ্দ হয়নি বলে হতাশ ছিলেন এই কর্মীরা। রাজ্যে আশাকর্মীদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল স্মার্টফোনের। সাম্প্রতিক বাজেটে মন্ত্রী বলেছেন, প্রকল্পের কর্মীরা প্রান্তিক মানুষের কাছে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া-সহ মা ও শিশুদের পুষ্টির বিষয়টা দেখার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করায়, তাঁদের স্মার্টফোনের প্রয়োজন মেটানো হয়েছে। যদিও এ দায়িত্ব পালন করার জন্য সকলকেই অনেক আগে থেকেই স্মার্টফোন কিনতে হয়েছে। তবুও এই ফোন দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সকলেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের হল, এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও তাঁদের পারিশ্রমিক বা ভাতা একদমই বাড়ানো হল না।
কিছু দিন আগে কর্নাটক সরকার আশাকর্মীদের ১০ হাজার টাকা বেতনের দাবি মেনে নিয়েছে। মাসিক মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতনে বছরের পর বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে গিয়েছেন কর্নাটকের আশাকর্মীরা। অতিমারির সময়ে আশাকর্মীদের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রাজ্য সরকারগুলিও এঁদের প্রশংসা করেছে। অথচ, তাঁদের সরকারি কর্মচারীর স্বীকৃতি মেলেনি, সাম্মানিকও বাড়ানো হয়নি। বাধ্য হয়ে ৭ জানুয়ারি থেকে কর্নাটক জুড়ে ধর্মঘট শুরু করেন ২৫ হাজারেরও বেশি আশাকর্মী। বেঙ্গালুরুর ফ্রিডম পার্কে তাঁরা লাগাতার বিক্ষোভ অবস্থানে শামিল হন। শেষ পর্যন্ত উদাসীন সরকারের টনক নাড়িয়ে প্রতি মাসে ৫০০০ টাকার পরিবর্তে ১০,০০০ টাকা সাম্মানিকের দাবি আদায় করেছেন তাঁরা। প্রশ্ন উঠেছে কর্নাটক সরকার যদি আশাকর্মীদের সাম্মানিক বাড়াতে পারে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন করল না? তা হলে কর্নাটকের মতোই কি এ রাজ্যের আশাকর্মীদেরও লাগাতার প্রতিরোধ আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে হবে, প্রশ্ন প্রকল্পের কর্মীদের।
প্রচণ্ড অনটনের সংসারে কিছু উপার্জনের আশায় এঁরা কাজ করতে এসেছেন। নির্ধারিত দায়িত্ব ছাড়াও বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভোটার লিস্টের কাজ-সহ অনেক সরকারি কাজ এঁদের দিয়ে করানো হয়। সারা দিন কাজ করে এঁরা এত নগণ্য সাম্মানিক পান যা দিয়ে এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে সংসার চালানো যায় না। ফলে, এঁদের সাম্মানিক বৃদ্ধি ন্যায্য পদক্ষেপ হবে।
অনুরূপা দাস, পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর
দৈন্য দশা
‘টাকা কোথায়’ (১৪-২) শীর্ষক সম্পাদকীয়টি রাজ্যের বর্তমান বেসামাল আর্থিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের শেষ প্রান্তে এসে রাজ্যের রাজস্ব ঘাটতি প্রায় ৪৩,২৬২ কোটি, রাজকোষ ঘাটতি ৭৩,০১৭ কোটি এবং পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭,০৬,৫৩১ কোটি, সেখানে কোষাগারের স্বাস্থ্যের দুর্দশাই আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। এমতাবস্থায় রাজ্য সরকার যে ভাবে একশো দিনের কাজ ও আবাস যোজনা-র পরিবর্ত হিসেবে নিজস্ব তহবিল থেকে জেদের বশেই খরচ করছে, তা অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। সম্পাদকীয়তে তাই উল্লেখ করা হয়েছে, যে রাজ্যের কাঁধে ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে, তার পক্ষে এতখানি জেদের ধকল সহ্য করা কঠিন। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে জঙ্গলগুলিতে পর্যটকদের থেকে প্রবেশ মূল্য বন্ধ করার ফলে বিপাকে পড়েছে বন দফতরের অধীন বন পরিচালন কমিটিগুলি। বিঘ্নিত হতে চলেছে জঙ্গলের উন্নয়নমূলক কাজ এবং এর সঙ্গে জড়িতদের রোজগার। এর পর হয়তো দেখা যাবে, এই সমস্ত দৈনন্দিন কাজের অর্থ জোগান দেওয়া হচ্ছে রাজ্যের কোষাগার থেকেই। এই ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত কখনওই কোনও দক্ষ প্রশাসকের কাজ হতে পারে না।
সম্পাদকীয়তে শিক্ষা এবং মহিলা ও শিশুকল্যাণ খাতে যথেষ্ট বরাদ্দ বৃদ্ধি না করার জন্য ভোটের রাজনীতির যে কথা বলা হয়েছে, তা রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অনুচিত বলেই মনে হয়। সম্প্রতি শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, খয়রাতি মানুষকে কর্মবিমুখ ও পরজীবী করে তুলছে, যা রাজ্যের সাম্প্রতিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাই রাজনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রের ঘাড়ে সমস্ত দোষ না চাপিয়ে রাজ্য সরকারের উচিত, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের ক্ষেত্রে রাজ্যে ঘটে চলা অনিয়ম বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আগামী দিনে যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রতিফলন রাজ্যের কোষাগারেই ফুটে উঠবে। এই ভাবে রাজ্যের আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে সরকারের নিজের পায়ের মাটি মজবুত করতে পারলে, ভবিষ্যতে মা মাটি মানুষের সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও আনুগত্যের অভাব ঘটবে না।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
কথার মারপ্যাঁচ
‘নতুন শঙ্কা, পুরনো দুঃস্বপ্ন’ (১৪-২) শীর্ষক প্রবন্ধে আগামী অর্থবর্ষের জন্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর বাজেট-বক্তৃতা বা আলোচনা প্রসঙ্গে অচিন চক্রবর্তী মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কথার মারপ্যাঁচে দেশীয় অর্থনীতির হতাশাব্যঞ্জক চিত্রটাকে আড়াল করার একটা অপচেষ্টার কথাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই বক্তব্যের সমর্থনে কিছু উদাহরণও তিনি পেশ করেছেন। বেকারত্বের হার ২০১৭-১৮য় ৬ শতাংশের সামান্য বেশি থেকে অতি সম্প্রতি ৩.২%-এ নামিয়ে আনার কৃতিত্ব হিসেবে সরকার যে ‘কর্মসংস্থান’-এর দাবি করেছে, তাকে প্রায় নস্যাৎ করে দিয়ে তিনি বলেছেন, “যে ‘কর্মসংস্থান’-এর জন্য বেকারত্ব কমে গেছে বলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগটাই আসলে বিনা মজুরিতে পারিবারিক উদ্যোগে যুক্ত থাকা মহিলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য।” আবার “মানুষ বাঁধাবাধি চাকরিতে না গিয়ে স্বাধীন উদ্যোগের দিকে ঝুঁকছে”— সরকারের এই দাবির বিপ্রতীপে গিয়েও উপযুক্ত প্রমাণ সহযোগে তিনি জানিয়েছেন, “নিয়মিত চাকরিতে তিন গুণ বেশি রোজগার হলেও তাঁরা শুধুমাত্র নিজের সুবিধামতো সময়ে কাজের স্বাধীনতার জন্যে বেছে নিচ্ছেন স্বনিযুক্তি, এটা মানা কঠিন। আসলে নিয়মিত মাইনের চাকরির অভাবই বাধ্য করছে স্বনিযুক্তি বেছে নিতে।” নিজেদের সুবিধামতো তথ্য তৈরি করে তার মাধ্যমে সত্যকে সাধারণের থেকে আড়াল করার প্রবণতা— এও এক ধরনের প্রতারণারই শামিল।
এর ফলে আমরা যে শুধুমাত্র দেশের প্ৰকৃত অর্থনৈতিক চিত্র থেকেই বঞ্চিত হচ্ছি, তা-ই নয়, যা জানছি সেটাও ‘ভুল’ জানছি। এ প্রসঙ্গে করবিহীন আয়ের ঊর্ধ্বসীমা বছরে ৭ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২ লাখ টাকাতে নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর যে যুক্তি— “মধ্যবিত্ত মানুষের কথা শুনে, দেশের উন্নতিতে তাঁদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতেই এই কর ছাড়” বা “এ বছরের বাজেট মধ্যবিত্তের স্বপ্নপূরণের বাজেট”, সেগুলোরও উল্লেখ করা যেতে পারে। সত্যিই কি মধ্যবিত্ত এই পদক্ষেপের ফলে উপকৃত হলেন? প্রত্যক্ষ কর পর্ষদের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের ফলে করের আওতার বাইরে বেরিয়ে যেতে চলেছেন ৮০-৮৫ লক্ষ মানুষ আর ২.৫ কোটি করদাতার করের দায় কমবে। উল্লেখযোগ্য হল, এই শেষোক্তরা শুধু মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বই করেন না। কর ছাড়ের সুবিধেটা মূলত যাঁদের কাছে পৌঁছচ্ছে, তাঁরা আদপেই ‘সাধারণ মধ্যবিত্ত’ শ্রেণিভুক্ত নয়। অথচ যে প্রকল্পের উপর দেশের অধিকাংশ লোক নির্ভরশীল, গ্রামের কোটি কোটি মানুষের বড় অংশের কাছে সারা বছরের আয়ের উৎস বলতে যে একশো দিনের কাজ বা ‘মনরেগা’, সেই খাতে ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে বাজেট বরাদ্দ এক টাকাও বাড়েনি।
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪