দিল্লিতে গিয়ে রাহুল গাঁধীর কাছে বামেদের সঙ্গে জোট চেয়েই দরবার করেছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা। এ বার কলকাতায় এআইসিসি-র প্রতিনিধির কাছে আরও জোরালো ভঙ্গিতে সেই দাবি তুললেন একের পর এক জেলা কংগ্রেস নেতৃত্ব। এমনকী, প্রদেশ কংগ্রেসের অন্দরে যাঁরা ‘একলা চলো’ লাইনের প্রবক্তা বলে পরিচিত, তাঁদের জেলা থেকেও দাবি উঠল বামেদের সঙ্গে সমঝোতার।
তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-র সঙ্গে জোটের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেও পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে চূড়ান্ত অবস্থান এখনও ঘোষণা করেনি কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। এআইসিসি-র একটি সূত্রের খবর, আগামী সপ্তাহে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি কী সিদ্ধান্ত নেয়, তার জন্য অপেক্ষা করছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এমতাবস্থায় বাংলায় দলের সাংগঠনিক অবস্থা বুঝে ঘর গোছানোর কাজ দেখভালের জন্য শহরে এসেছিলেন এআইসিসি-র সম্পাদক পরেশ ধনানি। বিধান ভবনে প্রদেশ কংগ্রেসের বেশ কয়েক জন সাধারণ সম্পাদক, বিধায়ক, সব জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ও শাখা সংগঠনদের প্রধানদের সঙ্গে রবিবার প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার বৈঠক সেরেছেন গুজরাতের এই তরুণ বিধায়ক। কংগ্রেস সূত্রের খবর, রাহুলের মতোই পরেশ জেলার নেতাদের কাছে তিনটি রাস্তার কথা বলেছিলেন— তৃণমূলের সঙ্গে জোট, বামেদের সঙ্গে সমঝোতা বা একলা চলা। তৃণমূলের হাত ধরার প্রশ্ন সমস্বরে নাকচ করে বামেদের সঙ্গে জোটের পক্ষেই মত দিয়েছেন জেলার সিংহভাগ নেতা। তাঁদের এই মত এআইসিসি-কে পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন পরেশ।
দলীয় সূত্রের খবর, প্রদেশ কংগ্রেসে মানস ভুঁইয়ার অনুগামী বলে পরিচিত অজয় ঘোষ, খালেদ এবাদুল্লা এবং তার পাশাপাশি মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী সুব্রতা দত্ত ‘একলা চলো’র পক্ষে এ দিনও সওয়াল করেছেন। কিন্তু বৈঠকে জেলা সভাপতিদের মত ছিল বামেদের সঙ্গে জোট গড়ার পক্ষেই। মানসবাবুর ভাই এবং তাঁর জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেসের সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়াও বাম-সঙ্গে আপত্তি জানাননি বলে দলীয় সূত্রের খবর। আবার দীপা দাশমুন্সির জেলা উত্তর দিনাজপুরের সভাপতি মোহিত সেনগুপ্তের প্রতিনিধি বৈঠকে হামিদুর রহমান, গোলাম রব্বানির মতো বিধায়কদের শাসক দলে যোগদানের প্রসঙ্গ টেনে সওয়াল করেছেন, কী ভাবে কংগ্রেসের সমর্থনে জিতে তাদেরকেই ভাঙার লাগাতার চেষ্টা চালাচ্ছে তৃণমূল! বিধায়ক দেবপ্রসাদ রায়ের জেলার সভাপতি বিশ্বরঞ্জন সরকার যুক্তি দিয়েছেন, বামেদের হাত ধরলে উত্তরবঙ্গে কংগ্রেস কী ভাবে লাভবান হতে পারে। বীরভূমের জেলা সভাপতি আবার সরাসরিই বলেছেন, এই অবস্থায় তৃণমূলের সঙ্গে যাওয়ার মানে বিষ খাওয়া!
জেলার নেতাদের সুরেই কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব বৈঠকে বলেন, সিপিএমের সঙ্গে অতীতে তাঁদের বহু লড়াই হয়েছে। কিন্তু এ ভাবে কংগ্রেসের অস্তিত্ব শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা তৃণমূলের মতো কেউ করেনি! কংগ্রেস কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পুলিশি চাপ দিয়ে কাটোয়ার বর্ষীয়ান বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে কী ভাবে তৃণমূলে টেনে নেওয়া হয়েছে, সেই ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে এআইসিসি-র প্রতিনিধির সামনে। পরে এই প্রসঙ্গে পরেশ বলেন, ‘‘দলের জেলা স্তরের নেতারা তাঁদের মত স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এআইসিসি যথেষ্ট বিচক্ষণ। এখানকার নেতা-কর্মীদের ভাবাবেগ মাথায় রেখেই তারা সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমি মনে করি। বাংলার মানুষ কী চাইছেন, কয়েক দিনের মধ্যেই শাসক দল টের পাবে!’’ যে মন্তব্যের মধ্যে বাম-জোটের গন্ধই পাচ্ছেন প্রদেশ কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা।
বাম-কংগ্রেস জোট তৎপরতার মধ্যেই আজ, সোমবার আবার শহরে একসঙ্গে পথে নামছেন দু’দলের নেতারা। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্যাম্পাসে গণতন্ত্রের দাবিতে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কণ্ঠরোধের প্রতিবাদে আজ কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত মিছিলে হাঁটার কথা কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান, অরুণাভ ঘোষ, ওমপ্রকাশ মিশ্র, সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়দের।
প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য অবশ্য এ দিনই ইঙ্গিত দিয়েছেন বামেদের সঙ্গে সার্বিক জোটের বদলে আসন সমঝোতা হতে পারে। এআইসিসি-র তরফে এ রাজ্যের পর্যবেক্ষক সি পি জোশী এবং সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির মধ্যে বার্তা বিনিময় চলছে বলেও তাঁর দাবি। দার্জিলিং জেলা কংগ্রেসের উদ্যোগে মাটিগাড়ার আঠারোখাই অঞ্চলের কর্মী সম্মেলন শুরুর আগে এ দিন প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘দুই দলের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই সার্বিক জোট এই অল্প সময়ের মধ্যে হয়তো সম্ভব নয়। আমরা আসন সমঝোতা নিয়ে এগোচ্ছি। সেই পথেই দুই তরফে কথাবার্তা চলছে।’’ তাঁর যুক্তি, পরিস্থিতির প্রয়োজনেই বাম বা কংগ্রেসকে এমন রাজনৈতিক কৌশল নিতে হচ্ছে। আর এক প্রদেশ কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্রেরও বক্তব্য, ‘‘কংগ্রেস পাঁচ বছর আগে পরিবর্তন এনেছিল। তার থেকেও জরুরি আর একটা পরিবর্তন এ বার দরকার হয়ে পড়েছে! সেখানে কৌশলগত ভাবে বামেদের সঙ্গে আমরা এগোতে পারি। এতে সমস্যার কিছু নেই।’’
বিরোধীদের জোট-প্রস্তুতি গতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা আক্রমণ আসছে শাসক দলের তরফেও! গার্ডেনরিচে এ দিন তৃণমূলের রাজনৈতিক সম্মেলনে যেমন কংগ্রেসের কড়া সমালোচনা করেছেন সাংসদ কল্যাণ বন্দোপাধ্যায় ও রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। কল্যাণ বলেন, ‘‘এক সময় সিপিএমের হাতে তাঁর বাবা রাজীব গাঁধী ও ঠাকুরমা ইন্দিরা গাঁধী তীব্র অপমানিত হয়েছেন। অথচ রাহুলজি আজ সিপিএমের সঙ্গে জোট বাঁধতে চাইছেন! আমরা রাজীবজি’কে সম্মান করি। তাঁর ইজ্জত মাটিতে মিশিয়ে দিতে চাইছেন রাহুল!’’ ফিরহাদের মন্তব্য, ‘‘ভাগ্যিস আমরা আলাদা দল গড়ে তুলেছি! কংগ্রেসে থাকলে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যেত!’’ যার জবাবে প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তীর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘রাজীবজি’র প্রতি কৃতজ্ঞতা ভুলে কংগ্রেসকে ভাঙার চেষ্টা কারা করেছে? রাজীবজি’র ছেলেকে বসন্তের কোকিল কে বলেছিল? তার পরেও এ সব কথা শুনতে হবে?’’