কমরেডগণ, তা হলে একটা কাজ করুন! বন্দুক নিয়ে জঙ্গলেই চলে যান!
কংগ্রেসের সঙ্গে ভবিষ্যতে নির্বাচনী সমঝোতার সম্ভাবনার কথা শুনেই দলের মধ্যে যাঁরা ফুঁসে উঠছেন, তাঁদের উদ্দেশে বলেছেন দলেরই এক সহকর্মী। আলিমুদ্দিনে সিপিএমের সদ্যসমাপ্ত রাজ্য কমিটির বৈঠকে। ওই নেতার যুক্তি, ভোটে ভাল ফল করতে না পারলে জনমানসে আর রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব কী? ভোটের জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল তৈরির সময়ে যদি নমনীয়তাই না থাকে, যদি আগেই দরজা বন্ধ করে বসে থাকতে হয়, তার চেয়ে সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে একেবারে বেরিয়ে গেলেই হয়। তা হলে শুধু তাত্ত্বিক আদর্শ নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোই ভাল!
দু’মাস আগের পার্টি কংগ্রেস থেকে সিপিএম যখন নির্বাচনী সমঝোতার প্রশ্নে গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলেছে নিজেদের, তার পরেও কংগ্রেস-প্রশ্ন ফের দলের মধ্যে সেই পুরনো বিতর্ক ফিরিয়ে এনেছে। বঙ্গ ব্রিগেডের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সেই সনাতন দ্বন্দ্ব! যদিও সিপিএমের বর্তমান কাণ্ডারী সীতারাম ইয়েচুরি আন্দোলন বা নির্বাচনী সমঝোতার ক্ষেত্রে উদারপন্থী বলেই পরিচিত। তবু দলের পার্টি কংগ্রেসই তাঁর হাত-পা বেঁধে ফেলেছে! আর এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেবের সাফল্য দেখছে সিপিএমের একটি বড় অংশ। নিজস্ব কায়দায় তিনি বন্ধ হয়ে-যাওয়া একটি বিতর্কের মুখ ফের খুলে দিতে পেরেছেন। বিধানসভা ভোটের মাসদশেক দূরে দাঁড়িয়ে রাজ্য কমিটির টেবিলে ফেলে দিতে পেরেছেন কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাঁতের প্রশ্ন। এবং সেই পথে কিছুটা সুযোগ এনে দিয়েছেন স্বয়ং ইয়েচুরির জন্যও।
ঘটনা যে, ইয়েচুরি কলকাতায় বসে প্রকাশ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও রকম নির্বাচনী আঁতাঁতের সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। উল্লেখ করেছেন বিশাখাপত্তনম পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের কথা। যাকে বৃন্দা কারাট নাম দিয়েছেন ‘ভাইজ্যাগ লাইন’। কিন্তু সে সবই সাধারণ সম্পাদক হিসাবে প্রকাশ্যে তাঁর বাধ্যবাধকতা। আসলে দলের অন্দরে তিনিও খুঁজে চলেছেন সম্ভাব্য কোনও সূত্র। যা ধরে পার্টি কংগ্রেসের বন্ধ দরজায় আবার ফাঁক বার করা যায়! যে কারণে এ বারের রাজ্য কমিটিতে জবাবি ভাষণে ইয়েচুরি বলে গিয়েছেন, নির্বাচনী কৌশল নিয়ে আলোচনা নির্বাচনের সময়েই হবে। অর্থাৎ চ্যাপ্টার এখন ক্লোজ্ড নয়। সাধারণ সম্পাদকের এই মন্তব্যে উৎফুল্ল বঙ্গ ব্রিগেডের একাংশ। সাধারণ সম্পাদককে এই সুযোগ এনে দিয়েছেন গৌতম এবং তাঁর সমর্থকেরাই।
সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘বিধানসভা ভোটের আগে সময় আছে। এখন কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নটা আবার উঠে এল মানে এটা নিয়ে চর্চা চলবে। নানা জনের নানা মত আসবে। তাতে নিচু তলার কর্মীরাও জড়িয়ে প়ড়বেন।’’ দলের বড় অংশের ধারণা, সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার অছিলায় গৌতমবাবু কৌশলে কংগ্রেস-প্রশ্ন ভাসিয়েছেন বিতর্ক পাকিয়ে তোলার জন্যই। যাতে বির্তকের শেষে একটা পথ বার করা যায়। আবার বির্তক দেখা দিয়েছে দেখে রাজনীতিকদের চেনা কায়দায় মন্তব্যের দায় অস্বীকারও করেছেন!
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন পার্টি কংগ্রেসে মীমাংসা হয়ে যাওয়া একটা তর্ককে আবার জাগিয়ে তুলতে হচ্ছে? সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, তার কারণ নির্বাচনী সমীকরণই। আগে বিরোধী ভোট ভাগভাগি হওয়ার সুযোগ দীর্ঘ দিন যেমন ক্ষমতাসীন বামেরা পেয়েছে, পরিবর্তনের পরে সেই ফায়দাই তুলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যাচ্ছে বাম, কংগ্রেস এবং বিজেপি-র মধ্যে। এর মধ্যে দুই বিরোধী দলের ভোট এক জায়গায় আনতে পারলে অঙ্কের বিচারেই চাপে ফেলা যাবে শাসক দলকে। সেই সূত্রেই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শক্তি হিসাবে কংগ্রেস ও বামেদের কাছাকাছি আসা অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। গৌতমবাবুর ঘনিষ্ঠ এক সিপিএম নেতার কথায়, ‘‘স্কুল বা সমবায়ের ভোটে হারলেও তো খারাপ লাগে! তা হলে শাসক দলকে কোণঠাসা করতে বিধানসভা ভোটে কেন আটঘাঁট বেঁধে নামব না?’’ দলেরই এক রাজ্য নেতা বলছেন, ‘‘আমাদের দলে পরম্পরাগত ভাবে কংগ্রেস-বিরোধী ভাবাবেগ আছে। তৃণমূলের পাশে কংগ্রেস না দাঁড়ালে এ রাজ্যে ২০০৯-এ আমাদের বিপর্যয় শুরু হতো না, এই তথ্য মাথায় রেখে সনিয়া গাঁধীর দল সম্পর্কে ক্ষোভও আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কংগ্রেস-বিরোধী ভাবাবেগের চেয়ে তৃণমূল-বিরোধী মনোভাবই বেশি প্রবল।’’
গঠনতন্ত্রে যা-ই থাক, পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্তই যে সব ক্ষেত্রে শেষ কথা, এমন কথা মানতে নারাজ দলের একাংশ। রাজ্য কমিটির এক সদস্যের যুক্তি, ‘‘মার্ক্সবাদেই বলা আছে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের কথা। ভাইজ্যাগ লাইন ঠিক হওয়ার পরেও বিধানসভা ভোট হতে হতে গঙ্গা দিয়ে কত জল গড়াবে! তখনকার পরিস্থিতি বুঝে কেন সিদ্ধান্ত হবে না?’’ ইয়েচুরির ঘনিষ্ঠ কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘‘বিহারে নীতীশ কুমারদের সঙ্গে কংগ্রেস মিলে বিজেপিকে হারাতে পারলে তার চাপ আমরা অস্বীকার করতে পারব?’’