গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি ‘আনুগত্য’ প্রকাশ করেও জিতেন্দ্র তিওয়ারিকে বিজেপি-তে নেওয়া নিয়ে নিজেদের ‘ভিন্নমত’ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন রাজ্য বিজেপি নেতাদের একাংশ। আসানসোলের সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় বৃহস্পতিবার রাতেই ফেসবুকে স্টেটাস এবং ভিডিয়ো পোস্ট করে তাঁর ক্ষোভ জানিয়েছিলেন। শুক্রবার বাবুলের কথাকে সমর্থন করলেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। যিনি ঘটনাচক্রে দলের অন্দরের সমীকরণে বাবুলের ‘বিরোধী’ বলেই পরিচিত। রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুও সাফ জানিয়েছেন, তিনিও চান না জিতেন্দ্রকে বিজেপি-তে নেওয়া হোক। এ নিয়ে তাঁর আপত্তির কথা তিনি ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানিয়ে দিয়েছেন।
অর্থাৎ, তৃণমূলে যে ‘আদি এবং নব্য’ বিরোধী একটা সময়ে মাথাচাড়া দিয়েছিল, বিজেপি-তেও তা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে যোগদানের হিড়িক পড়ার পর এই বিরোধ এবং সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে বলে বিজেপি-র অন্দরেই আলোচনা শুরু হয়েছে। শুধু জিতেন্দ্রই নয়, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা সহ-সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে নিয়েও শুরু হয়েছে ক্ষোভ। নিজেকে সরাসরি ‘শুভেন্দু অনুগামী’ বলে ঘোষণা করে দলত্যাগ করা শ্যামাপ্রসাদকে যাতে বিজেপি-তে না নেওয়া হয় সেই দাবিতে বৃহস্পতিবারই বিষ্ণুপুরের বিজেপি নেতা-কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্য বিজেপি তাকিয়ে শনিবারের বারবেলার দিকে। শনিবার বেলা ৩টের সময় মেদিনীপুরে অমিত শাহের সভা। জল্পনা চলছে, শুভেন্দু অধিকারী-সহ অনেকে ওই সভা থেকে বিজেপি-তে যোগ দিতে পারেন। এখন দেখার, সেই মঞ্চে জিতেন্দ্রও জায়গা পান কি না। কারণ, বাবুল তাঁর ফেসবুক পোস্ট এবং ভিডিয়োয় জানিয়ে দিয়েছেন, জিতেন্দ্র যোগদানের বিষয়ে তিনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলবেন। বাবুলের বক্তব্য ‘সঙ্গত’ বলেই মনে করছেন দিলীপ। শুক্রবার তিনি বলেন, ‘‘বাবুলের বক্তব্য এবং জিতেন্দ্র তিওয়ারিকে মেনে নিতে না পারার কারণ সঙ্গত। আসানসোলে বিজেপি কর্মীদের উপরে লাগাতার অত্যাচার করেছেন জিতেন্দ্র। সাংসদ তথা মন্ত্রীকে কাজ করতে দেননি।’’ তবে পাশাপাশিই দিলীপের বক্তব্য, ‘‘গোটা সিদ্ধান্তটাই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। যা ঠিক হবে, সেটাই মেনে নিতে হবে।’’
বৃহস্পতিবারই তৃণমূল ছেড়েছেন জিতেন্দ্র। এর পরেই তাঁর বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার জল্পনা জোরাল হয়। আর তা হতেই ফেসবুকে তোপ দাগেন বাবুল। ফেসবুকে তিনি জানান, ‘আমার টপ বস্রা কী করেন, সেটা আলাদা ব্যাপার। সেই সিদ্ধান্তই সর্বোচ্চ। তাতে আমার কিছু বলার অধিকার নেই। কিন্তু আমার প্রচুর বিজেপি সহকর্মী এতদিন ধরে চূড়ান্ত ভাবে আক্রান্ত, নির্যাতিত, আহত হয়েছেন। জীবন দিয়েছেন। ভুয়ো কেসে জেলে রয়েছেন। এবং এই পুরো ব্যাপারটা তৃণমূলের মাননীয়া নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায়, তাঁর নির্দেশে আসানসোল-দুর্গাপুরের তৃণমূল নেতারা কার্যকর করেছেন। আপনারাও জানেন জিতেন্দ্র তিওয়ারি তাঁদের মধ্যে অন্যতম’। জিতেন্দ্র বিজেপি-তে যোগ দিলে সেটা তাঁর এবং স্থানীয় বিজেপি কর্মীদের কাছে ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে’ বলে বর্ণনা করে বাবুল আরও বলেছেন, ‘‘এঁদের কারও বিজেপি-তে যোগ দেওয়াটা আমি মন থেকে মেনে নিতে পারব না।’’
বাবুলের ঘনিষ্ঠরা মনে করছেন, তাঁর আপত্তিকে খুব একটা আমল দেবেন না বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বস্তুত, তাঁরা মনে করছেন বাবুল ওই ভাবে প্রকাশ্যে তাঁর ‘ভিন্নমত’ প্রকাশ না করলেই হয়তো ভাল করতেন। তিনি জিতেন্দ্র বিষয়ে তাঁর যে কোনও ‘হাত’ নেই, সেটুকু স্পষ্ট করেই ক্ষান্ত থাকতে পারতেন। কারণ, এর পরেও জিতেন্দ্র বিজেপি-তে যোগ দিলে বাবুল খানিকটা ‘বিড়ম্বনা’য় পড়তে পারেন। বাবুল অবশ্য পাশাপাশিই জানিয়ে রেখেছেন, জিতেন্দ্রর বিজেপি-তে যোগদানের বিষয়ে তাঁর আপত্তি ‘ব্যক্তিগত’। ওই বিষয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ঠিক যেমন বলেছেন দিলীপ। তবে দিলীপের থেকেও বেশি আক্রমণাত্মক সায়ন্তন। তিনি বলেন, "আসানসোলে পর দু'বার ওঁকে ছাড়াই তো আমরা জিতেছি। মানুষ ওঁর বিরুদ্ধেই বিজেপি-কে ভোট দিয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনের বিচারে ওই আসনের অন্তর্গত সবক'টি বিধানসভা কেন্দ্রেই বিজেপি এগিয়ে। এটাই আমি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানিয়েছে। বলেছি, ওঁকে নেওয়া ঠিক হবে না।’’ কিন্তু এর পরেও সায়ন্তনের সংযোজন, ‘‘তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যা করবে সেটাই হবে।" তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে আসা দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায় অবশ্য জিতেন্দ্র প্রসঙ্গে এখনও পর্যন্ত কোনও মন্তব্য করেননি। তবে তাঁর বক্তব্যও ‘ইঙ্গিতবহ’। মুকুল সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘শুভেন্দু গণ-আন্দোলনের ফসল। তাঁর সঙ্গে অন্য কাউকে মেলানো ঠিক নয়।’’