বন্ধ পড়ে রয়েছে গোঘাটের শান্তিপুরে সিপিএমের কার্যালয়। ছবি: প্রকাশ পাল।
একটা সময় ছিল, ভোট ঘোষণার ছ’মাস আগে থাকতে দেওয়াল সাদা রঙ করে তাতে লাল কালিতে লেখা থাকত, ‘সাইট ফর সিপিআইএম’। পাশে উল্লেখ থাকত, দীর্ঘমেয়াদী দখলের তারিখ, যেমন ১৯৮০-২০১১।
একটা সময় ছিল, শহর তো বটেই ভোট এলে গ্রামের প্রতি পাড়ার দেওয়ালগুলি ভরে উঠত বামেদের লাল পতাকা পোস্টার-ফেস্টুনে। রাস্তাঘাট-বাজার-গাছের ডাল— সর্বত্র মুড়ে ফেলা হত দলীয় পতাকায়। গ্রামের মোড়ে মোড়ে থাকত কার্লমার্কস-সহ বামপন্থী মনীষীদের ছবি।
একটা সময় ছিল, ‘ইনকিলাব’শব্দটি কে কত ক্ষণ শ্বাস ধরে রেখে উচ্চারণ করতে পারে, পাড়ায় পাড়ায় চলত তার প্রতিযোগিতা।
সে দিন গিয়েছে। একদা ‘লালদুর্গ’বলে পরিচিত হুগলির আরামবাগ মহকুমায় এখন বামেদের সেই তাঁব কোথায়! বুধবার পর্যন্ত আরামবাগ বিধানসভা এলাকায় সিপিএমের একটা দেওয়াল লিখনও নেই। কোথাও দলীয় পতাকাও চোখে পড়ছে না। মহকুমার বাকি অংশ গোঘাট, পুড়শুড়া এবং খানাকুল বিধানসভা এলাকায় সব মিলিয়ে মাত্র খান সত্তর দেওয়ালে লিখতে পেরেছে সিপিএম কিছু দলীয় পতাকাও টাঙিয়েছে। যদিও সেই পতাকা পর দিনই হয় তো মাটিতে লুটিয়ে গড়াগড়ি খেতে দেখা গিয়েছে। নয় তো কিছু লাল পতাকা তো বেমালুম উধাও।
পাড়া ধরে ধরে আগে প্রতিদিন কী ঢঙে প্রচার চালাত সিপিএম?
সমর্থক হোন আর না-ই হোন, সিপিএমের প্রচারের ক্যারিশমায় মুগ্ধ হতেন আরামবাগবাসী। জানা গেল, ‘ইনকিলাব’ বাক্যটা কত দীর্ঘক্ষণ ধরে বলা যায়, তার প্রতিযোগিতা চলত। শব্দটি উচ্চারণ করতে করতে কে কত মিটার পথ হাঁটতে পারে, তা-ও ছিল এক দেখার মতো জিনিস। দলের প্রার্থী আসুন বা না আসুন প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য প্রতিটি বাড়িতে একদিন এলেন মহিলা সমিতি, তো পর দিন এলেন পাড়া কমিটির নেতারা। তার পর দিন হয় তো পায়ের ধুলো পড়ল কৃষকসভার নেতা-কর্মীদের। দলের যুব সংগঠন থেকে শুরু করে শিক্ষক সংগঠন, বামপন্থী বুদ্ধিজীবী— সকলেই এক বার না এক বার ঘুরে যেতেন প্রায় প্রতিটি বাড়িতে।
এ বার সে সব উধাও। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা আরামবাগের জোনাল কমিটির নেতা মোজাম্মেল হোসেনের অভিযোগ, “তৃণমূলের সন্ত্রাসে মানুষ আতঙ্কিত। অনেকেই আমাদের দেওয়াল ব্যবহার করতে দেওয়ার লিখিত সম্মতি দিচ্ছেন। সেই দেওয়ালে আমরা চুন দেওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে তৃণমূল। কোথাও কোথাও আবার দেওয়াল মালিকের বিনা অনুমতিতেই আমাদের চুন-করা দেওয়ালে লিখে দিচ্ছে ওরা। আমাদের ভীত সন্ত্রস্ত হওয়ার প্রশ্ন নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষকে যাতে বিপদে না পড়তে হয়, সে জন্যই আমরা দেওয়াল লেখা স্থগিত রেখেছি।” মোজাম্মেল জানান, পোস্টার-ফেস্টুন-ফ্লেক্স ব্যবহার-সহ নির্বাচনী প্রচার কোন কৌশলে করা যায়, সে বিষয়ে দলে আলোচনা হচ্ছে। সিপিএম নেতার দাবি, “আমাদের প্রার্থীর প্রচারে মানুষের যোগদান ও উদ্দীপনা দেখেই তৃণমূল আতঙ্কিত হয়ে প্রচারে বাধা দিচ্ছে।” বিরোধীদের আরও অভিযোগ, বিভিন্ন গ্রামের বুথে সম্ভাব্য যে সব নেতা-কর্মী সিপিএম প্রার্থীর এজেন্ট হতে পারেন, তাঁদের নামে ‘এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে’ বা ‘শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে পারে’— এই মর্মে ১০৭ ধারায় অভিযোগ করা হচ্ছে। ফৌজদারি এই মামলায় ওই কর্মীরা মুচলেকা দিয়ে ঘরে চুপচাপ বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। আরামবাগের মহকুমাশাসক অরিন্দম রায় জানান, বুধবার পর্যন্ত মহকুমায় মোট ১০২৬ জনের নামে ১০৭ ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। তার মধ্যে ৯১৬ জন ইতিমধ্যে মুচলেকা দিয়েছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্ত অবশ্য বলেন, “সিপিএমের এখন ওখানে কোনও সংগঠনই নেই। নিশ্চিত হার জেনে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার করছে।”
সিপিএমের অভিযোগের সারবত্তা কত, তার বিচার করবে পুলিশ-প্রশাসন। তবে প্রচারের চটকে পুরনো মেজাজটাই যে উধাও হয়েছে, এক বাক্যে সে কথা মেনে নিচ্ছেন আরামবাগবাসী।
(চলবে)