নিজের দোকানে কাজ করছেন কবিতদেবী। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
স্বপ্ন ছিল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার। কিন্তু বাবার অসুস্থতার জন্য পড়াশোনা বেশিদূর এগোয়নি। বছর চল্লিশের কবিতা বিশ্বাস ’৯২ সালে বিয়ে হয়ে চলে আসেন বনগাঁর মতিগঞ্জে অপূর্ববাবুর সঙ্গে ঘর করতে।
তার পরে যা হয়। শ্বশুরবাড়ির দেখভাল আর সংসারের চাপে ফিকে হয়ে গিয়েছিল নিজের স্বপ্নটা। হয়তো তা চাপাই পড়ে যেত। কিন্তু ২০০০ সালে স্বামীর ছোট্ট ওষুধের দোকানটা যখন ইছামতীর সেতু তৈরির জন্য ভাঙা পড়ল, তখন খানিকটা বাধ্য হয়েই ব্যবসায়ে নেমে পড়লেন কবিতা। সামান্য জ্ঞান নিয়েই শুরু করলেন ওষুধের পাইকারি ব্যবসা। দীর্ঘ ১৩ বছরের লড়াইয়ের পরে স্বনির্ভর তো তিনি বটেই, বনগাঁ এলাকার একজন বড় ব্যবসায়ী বললেও অত্যুক্তি হয় না।
বেহালার মেয়ে কবিতা নিজেই এখন একটা ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান। তাঁর কথায়, “বি কম পাশ করার পরে যখন চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই বাবা অসুস্থ হলেন। আর পড়াশোনা হল না। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। অবসরে খুব হতাশ লাগত। ভাবতাম কী করা যায়? স্বামীর সঙ্গেও আলোচনা করতাম। ভেবেছিলাম, সরকারি চাকরির চেষ্টা করব। কিন্তু ২০০০ সালে ইছামতীর উপর সেতু তৈরির জন্য স্বামীর ছোট্ট ওষুধের দোকানটা ভাঙা পড়ল। অবশ্য তখন দোকানে বিক্রিও কম ছিল। আবার নতুন করে শুরু করতে হল। আর সেই শুরুটাই এখন আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।”
যখন শুরু করেছিলেন, তখন পুঁজি বলতে এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ধার করা ৮০ হাজার টাকা। ধীরে ধীরে ব্যবসা বনগাঁ শহরের সীমা ছাড়িয়ে গাইঘাটা, বাগদা, চাকদহ -সহ গোটা উত্তর ২৪ পরগনা জেলাতেই ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বছরে প্রায় কোটি টাকা লেনদেন হয় ব্যবসায়।
সাফল্যের পিছনে পরিশ্রমও কম নেই। সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠে সাংসারিক কাজকর্ম সামলে কবিতা চলে আসেন বাড়ির একতলার ছোট্ট দোকানঘরে। অনেক সময়ে কারিগরদের হাত দিয়ে ওষুধ পৌঁছে দেন বিভিন্ন দোকানে। অনেকে দোকানেই আসেন। ব্যবসার পাশাপাশি, সংসারকেও নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছেন তিনি। ছেলে অর্ক মাধ্যমিকে বনগাঁ মহকুমায় প্রথম হয়েছিল। এখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র।
স্ত্রীর কৃতিত্বে গর্বিত অপূর্ববাবুও। বললেন, “ওঁর জন্যই সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। কাজের মধ্যে থেকে কবিতাও মানসিক তৃপ্তি পাচ্ছে।” আর কবিতার বক্তব্য, “প্রতিটি মহিলারই আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হওয়া উচিত। তাতে সংসারের সুরাহা হয়। নিজেরও মর্যাদা বাড়ে।”
কবিতার এই উদ্যোগে উজ্জীবিত এলাকার মেয়েরাও। প্রতিবেশী সুপর্ণা রায় তো পাড়াতেই বুটিকের একটি দোকান করেছেন। বললেন, “উনি তো সব সময়ে ব্যস্ত। এক জন মহিলার এমন ব্যস্ততা দেখেও ভাল লাগে। আজকাল মেয়েরা চাকরিই বেশি করেন। কিন্তু ব্যবসায় অনেক ঝুঁকি আছে। সেই ঝুঁকি নিয়েও যে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়, তা দেখিয়েছেন কবিতাদেবী।”
আর কবিতাদেবীর কথায়, “ব্যবসায় মহিলারা সে ভাবে আসতে চান না। ভাবেন, এতে হয়তো সামাজিক সম্মান নষ্ট হবে। শ্বশুরবাড়ি থেকেও প্রতিবন্ধকতা থাকে। কিন্তু পরিস্থিতির মোকাবিলা করে যদি নিজের মতো কিছু করে দেখানো যায়, তবে মনে হয় জীবন থেকে নিজেরও কিছু পাওয়ার ছিল।”