সিঙ্গুরে বিজেপি-র মিছিল। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর শপথ গ্রহণের দিনেই ফের শিল্পায়নের দাবি উঠল সিঙ্গুরে।
সিঙ্গুরের যে জমিতে এখন টাটাদের পরিত্যক্ত কারখানা দাঁড়িয়ে, সেই জমিতেই ফের শিল্পের দাবিতে সোমবার বুড়োশান্তির মাঠ থেকে আলুর মোড় পর্যন্ত মিছিল করলেন মোদীর দলের কর্মী-সমর্থকেরাই। শ’দেড়েক মানুষের সেই মিছিলে যেমন দেখা গেল ‘ন্যানো বাঁচাও কমিটি’র সঞ্জয় পাণ্ডেকে, তেমনই ছিলেন তৃণমূল নেতৃত্বাধীন ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’র কর্মী সৌরেন পাত্রও। পা মেলালেন কয়েক জন ‘অনিচ্ছুক’ও।
আট বছর ধরে সিঙ্গুর নিয়ে রাজ্য-রাজনীতি কম উথাল-পাতাল হয়নি। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে মোদী নিজেই আনন্দবাজারকে জানিয়েছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে সিঙ্গুর-সহ এ রাজ্যে শিল্পায়নের চেষ্টা করবেন। তাই তাঁর শপথ গ্রহণের দিনে যে ভাবে ফের সিঙ্গুরের জমিতে শিল্পায়নের দাবি উঠল, তা তৎপর্যপূণর্র্ বলেই মনে করছেন রাজনীতির কারবাবিরা।
রাজ্যে গত দু’দফায় যখনই নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখনই প্রথম ঘোষণা হয়েছে সিঙ্গুর নিয়েই। আর তা নিয়েই চলেছে রাজনৈতিক লড়াই। এক পক্ষ শিল্পায়নের পক্ষে সওয়াল করেছিল। অন্য পক্ষ জোর দেয় চাষিদের জমি ফেরতের উপরে।
২০০৬ সালে ২৩৫টি আসন নিয়ে যখন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শপথ নেন, সে দিনই তিনি সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠীর এক লক্ষ টাকার গাড়ি কারখানার প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু তার কিছু দিনের মধ্যে সিঙ্গুরে জমি পরিদর্শনে গিয়ে গ্রামবাসীদের বিরোধিতার মুখে পড়েন টাটার প্রতিনিধিরা। এ নিয়ে বিধানসভায় তৃণমূল হইচই করায় সেই সময়ে বুদ্ধবাবুর ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০। কী করবে ওরা’ মন্তব্য নিয়েও কম শোরগোল হয়নি।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি কারখানা হয়নি। কয়েক বছর ধরে তৃণমূল নেতৃত্বাধীন ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’র জমি-আন্দোলনের জেরে ২০০৮-এর পুজোর আগে রতন টাটা ঘোষণা করেন, সিঙ্গুরে কারখানা নয়। এই পর্বে বিরোধী নেত্রী হিসেবে আগাগোড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের প্রতিশ্রুতি দেন, ক্ষমতায় এলে তাঁরা জমি ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু এখনও তা হয়নি।
বস্তুত, এই সিঙ্গুর-আন্দোলনের জেরেই বিরোধী নেত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী চেয়ারে আসীন হন মমতা। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার প্রথম সিদ্ধান্তই ছিল ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের জমি ফেরত দেওয়া। সে জন্য প্রয়োজনীয় আইনও তৈরি করে রাজ্য সরকার। কিন্তু সেই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে টাটা মোটরস কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে। হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ওই আইনকে ‘অসাংবিধানিক এবং অবৈধ’ বলে রায় দেওয়ায় রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়।
গোটা বিষয়টিই এখন বিচারাধীন। মামলা কবে মিটবে, কেউ জানেন না। ‘অনিচ্ছুক’রা এখনও জমি ফেরত পাননি। যাঁরা ছিলেন জমির মালিক, তাঁদের অনেকেই এখন দিনমজুরি করে সংসার চালান। ক্ষোভও কম নেই। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক বার তাঁদের ক্ষোভের প্রকাশও ঘটেছে। সেই ক্ষোভ আঁচ করে মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার ‘অনিচ্ছুক’দের জন্য টাকা ও চাল বরাদ্দ করেছে। কিন্তু গ্রামবাসীরা চান স্থায়ী সমাধান। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আগে বলেছিলেন, এই অবস্থার চেয়ে কারখানা হলেই ভাল হত।
তাই কেন্দ্রে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসায় নতুন করে যেন আশার আলো দেখছেন ওই এলাকার কিছু মানুষ। এক সময় সিঙ্গুর-আন্দোলনে সামিল হওয়া বেড়াবেড়ি পূর্বপাড়ার শিউলি দাস এ দিন বলেন,“সিঙ্গুরে কারখানা হলেই ভাল। জমি তো ফেরত পেলাম না। ছেলেটাকে পড়াশোনা শেখাতে পারলাম না। সংসার না দেখে আন্দোলন করলাম। কিন্তু আমরা কী পেলাম?” বিফল বাঙাল নামে আর এক গ্রামবাসী বলেন, “টাটারা চলে গিয়ে কার লাভ হল? আমার ছেলে তো প্রশিক্ষণ নিয়ে আজও বেকার। এখন কারখানা হলে তবেই সিঙ্গুর বাঁচবে।” ওই মিছিলে সামিল হওয়া আর এক গ্রামবাসীর কথায়, “কেন্দ্রে বিজেপি আসায় সিঙ্গুরে কারখানা হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে।”
বিজেপি নেতা সৌম্য চট্টোপাধ্যায় বলেন, “টাটারা না হলে অন্য কোনও শিল্পপতিকে দিয়ে সিঙ্গুরে কারখানা করতে হবে। দল কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসায় সেই সম্ভাবনা ফের দেখা দিয়েছে।” সিপিএমও বিজেপি-র এই দাবিকে স্বাগত জানিয়েছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, “ওই জমিতে কারখানার দাবি স্বাগত। বিজেপি কি গুজরাত থেকে ন্যানোকে রাজ্যে ফের ফিরিয়ে আনতে চাইছে? না এখানে বিকল্প ইউনিট চাইছে ন্যানোর? সেটা পরিষ্কার নয়।”
তবে, বিজেপি-র নেতৃত্বে এ দিনের মিছিলকে গুরুত্ব দিতে চাইছে না তৃণমূল। এমনকী, তাঁদের জমি রক্ষার আন্দোলনের কেউ এই মিছিলে পা মিলিয়েছেন, এ কথাও মানতে চাননি সিঙ্গুরের তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী বেচারাম মান্না। তিনি বলেন, “যে কোনও রাজনৈতিক দলই সিঙ্গুর নিয়ে লাফালাফি করতে পারেন। তাতে ভাল প্রচার পাওয়া যায়।
কিন্তু লোকসভা ভোটেই সিঙ্গুরের মানুষ দেখিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কাদের সঙ্গে আছেন।”