গ্রেফতারের পরে মিঠু নিয়োগী, চঞ্চল নিয়োগী এবং রাজ। পাশে রুম্পা। —নিজস্ব চিত্র।
বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসছে তারস্বরে চলা টিভির আওয়াজ। সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে মাংস পোড়া কটু গন্ধ পেয়ে সন্দেহ হয় প্রতিবেশীদের। কয়েক জন মিলে বাড়িতে ঢুকে দেখেন, টিভির সামনে বসে গৃহকর্ত্রী। ঘরের মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছেন আগুনে অর্ধেকেরও বেশি পুড়ে যাওয়া ওই বাড়িরই সদ্য বিবাহিত বৌটি। তাঁকে সামলানোর চেষ্টা করছে তাঁর শ্বশুর। আর ওই গৃহবধূর স্বামী আগুনে পোড়া বৌয়ের জন্য মাটিতে শুয়ে কান্নাকাটি করছে।
এই দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন প্রতিবেশীরা। সন্দেহও হয়েছিল। কিন্তু সময় নষ্ট না করে তাঁরা এলাকারই একটি গাড়ি করে ওই গৃহবধূকে পাঠিয়ে দেন হাসপাতালে। পরে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ। সেখানেই মৃত্যু হয় ওই গৃহবধূর। তাঁর বাড়ির লোকের অভিযোগ, মৃত্যুর আগে রুম্পা নিয়োগী (২২) নামে ওই বধূ অভিযোগ করে গিয়েছেন, তাঁর স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ি মিলে গায়ে কেরোসিন ঢেলে তাঁকে পুড়িয়ে দিয়েছে। দলবদ্ধ ভাবে বধূ নির্যাতন ও তাঁকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টার অভিযোগে পুলিশ রুম্পার স্বামী রাজ নিয়োগী, শ্বশুর চঞ্চল নিয়োগী এবং শাশুড়ি মিঠু নিয়োগীকে গ্রেফতার করেছে। শুক্রবার রাতে ঘটনাটি ঘটেছে বেলুড়ের বি কে পাল টেম্পল রোডে।
পুলিশ সূত্রের খবর, বেলুড় রাজেন শেঠ লেনের বাসিন্দা বিষ্ণুপ্রিয়া দাসের মেয়ে রুম্পার সঙ্গে আট মাস আগে বিয়ে হয় বি কে পাল টেম্পল রোডের সুভাষ পল্লির বাসিন্দা পেশায় জুট মিলের কর্মী রাজের। ওই তরুণীর পরিবারের লোকেরা জানিয়েছেন, বিয়ের আগে থেকেই পরিচয় ছিল রুম্পা ও রাজের। বিয়ের সময়ে নগদ ৩০ হাজার টাকা ও অন্যান্য জিনিসপত্র যৌতুক নিয়েছিল রাজের পরিবার। কিন্তু অভিযোগ, বিয়ের দশ দিন পর থেকেই আরও টাকার জন্য রুম্পার উপরে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন শুরু করে রাজ এবং তার বাবা-মা। ফেব্রুয়ারি মাসে অশান্তি করে মায়ের কাছে ফিরে যায় রুম্পা।
এ দিন তাঁর মা বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী বলেন, “রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের মধ্যস্থতায় বাবা হারা মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে ফেরত পাঠিয়েছিলাম। অত্যাচার করে জেনেও চুপ থাকতাম। ভাবতাম এক দিন হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এ ভাবে ওরা মেয়েটিকে মেরে ফেলবে জানলে পাঠাতাম না।”
স্থানীয়েরা পুলিশকে জানান, ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ রাজদের বাড়ি থেকে জোরে চলা টিভির আওয়াজের পাশাপাশি পোড়া গন্ধ পেয়ে সেখানে যান কয়েক জন প্রতিবেশী। তাঁরাই রুম্পাকে অগ্নিদ্বগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করেন। এক প্রতিবেশী অশোক পুরোহিত বলেন, “মেয়েটার হাত টেনে ধরে ছিল চঞ্চলদা। রাজের একটা হাতের কিছুটা অংশ আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। ও মেঝেতে শুয়ে বৌয়ের শোকে কাঁদছিল। এত কিছুর মধ্যেও ওর মা টিভিতে সিরিয়াল দেখছে। দেখে খুব আশ্চর্য লেগেছিল।” প্রতিবেশীরা জানান, এলাকার একটি গাড়িতে করে রাজের বাবা চঞ্চলকে দিয়েই রুম্পাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু রাজ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার নাম করে পালায়।
পুলিশ জানায়, এলাকা থেকে ফোনে বিষয়টি জেনেই বেলুড় থানার ওসি মহম্মদ ফিরোজ হোসেন তিনটি দল তৈরি করে বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দেন। একটি দল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যায় ওই গৃহবধূর অভিযোগ নিতে। আর একটি দল যায় ঘটনাস্থলে। তৃতীয় দল এলাকায় টহল দেয় রাজকে ধরার জন্য। রুম্পার মৃত্যু হতেই পুলিশ হাসপাতাল থেকে তাঁর শ্বশুর এবং বাড়ি থেকে শাশুড়িকে গ্রেফতার করে। রাজকে ধরা হয় রাস্তা থেকে। রুম্পার মাসতুতো দাদা ছোট্টু দাস বলেন, “খবর পেয়ে হাসপাতালে যাই। বোন তখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। বলল, বিকেল থেকে ঝগড়া হচ্ছিল। তার পরে শাশুড়ি পিছন থেকে ওঁর হাত বেঁধে দেয়। শ্বশুর গায়ে কেরোসিন ঢালে। আর বর দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে দেয়। চিৎকার শুনতে না পাওয়ার জন্য টিভির আওয়াজও জোরে করে দেয়।”
শনিবার পুলিশ সুভাষ পল্লির ওই বাড়িতে গিয়ে পোড়ার বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে। সেখানেই ভিড় জমিয়ে প্রতিবেশীরা দোষীদের শাস্তির দাবি জানান। তাঁরা জানান, ২০০০ সালে এক বার রাজের বিয়ে হয়। তখনও বৌকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয় ওই পরিবার। রুম্পার উপরেও অত্যাচার করত রাজেরা। এ দিন বিকেলে ওই বাড়িতে ভাঙচুর হয়। পরে এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়।