ধুঁকছে ঘড়া শিল্প, অন্য পেশায় কারিগররা

সরকার পক্ষ বলছে, গ্রামবাসীদের থেকে সহযোগিতা মিলছে না। গ্রামবাসীরা বলছেন, সরকারই উদাসীন। আর এই চাপান-উতোরের মধ্যে পড়ে ক্রমশ অবলুপ্তির পথে যাচ্ছে আরামবাগের প্রাচীন ঘড়া শিল্প।

Advertisement

পীযূষ নন্দী

আরামবাগ শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৪ ০১:২৮
Share:

ছাঁচ থেকে বের করে তৈরি হচ্ছে ঘড়া। ছবি: মোহন দাস।

সরকার পক্ষ বলছে, গ্রামবাসীদের থেকে সহযোগিতা মিলছে না।

Advertisement

গ্রামবাসীরা বলছেন, সরকারই উদাসীন।

আর এই চাপান-উতোরের মধ্যে পড়ে ক্রমশ অবলুপ্তির পথে যাচ্ছে আরামবাগের প্রাচীন ঘড়া শিল্প।

Advertisement

দ্বারকেশ্বর নদীর পশ্চিম পাড়ে গোঘাটের বালি, কলাগাছিয়া, জগত্‌পুর, রাধাবল্লভপুর এবং পূর্ব পাড়ের আরামবাগের মানিকপাট, রায়পুর এবং শেখপুর এই সাতটি গ্রামে পিতলের ঘড়া শিল্পের ইতিহাস বহু প্রাচীন। বছর কুড়ি আগে পর্যন্ত ওই সব গ্রামে অর্থনীতির মূল ভিত ছিল ঘড়া শিল্প। তখনও পর্যন্ত সাতটি গ্রামের হাজার দেড়েক পরিবার ওই শিল্প টিকিয়ে রেখে ছিলেন। এখন মাত্র ২৭৪টি পরিবার ওই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত।

কাঁচামালের দাম বেড়েছে। রুগ্ন শিল্পে জড়িত না থেকে অনেকেই খুঁজে নিচ্ছেন দিনমজুরি বা সোনা, জরি এবং কাঠের কাজ। পাড়ি দিচ্ছেন দিল্লি-মুম্বই। আর শিল্পের বেহাল অবস্থা দেখে কপাল চাপড়াচ্ছেন প্রবীণ কারিগরেরা। মহকুমার ‘ঘড়া শিল্প সমিতি’র সম্পাদক শঙ্কর কাবরী বলেন, “শিল্প টিকিয়ে রাখার মূল সমস্যা কয়লা এবং কাঁচামাল। সব কিছুরই দাম বেড়েছে। কিন্তু ঘড়া-ঘটি বেচে দাম সে ভাবে দাম মিলছে না। শিল্পটাকে বাঁচানোর জন্য আমরা সরকারের কাছে আবেদনও করেছি। কিন্তু কিছুই লাভ হয়নি।”

সব শেষে চলছে পালিশ।

জেলা শিল্পকেন্দ্রের কর্তারা ওই অভিযোগ মানছেন না। বস্তুত, দু’বছর আগে জেলা শিল্পকেন্দ্রের তরফে ওই এলাকায় শিল্পটিকে চাঙ্গা করতে ‘কমন ফেসিলিটি সেন্টার’ বা ‘সর্বজনীন সুবিধা কেন্দ্র’ গড়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু জমির অভাবে তা বাস্তবায়িত হয়নি। এর পরে কারিগরদের নিয়ে সমবায় গঠনের চেষ্টা হয়। সেই সমবায়ও এখনও গড়ে ওঠেনি। শিল্পকেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার সুবোধ প্রামানিকের দাবি, “শিল্পটির উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট মানুষদের প্রাথমিক পদক্ষেপটুকুও নেই। আমরা উদ্যোগী হলেও তাঁরা এগিয়ে আসছেন না। কেন্দ্র গড়ার জমি মেলেনি। ঘড়া বা ঘটি এখন সে ভাবে ব্যবহার হয় না। ওই কেন্দ্র হলে কারিগরদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বর্তমান সময়ের উপযোগী জিনিস বানানো যেত। সমবায় গঠনের চেষ্টাও কারিগররা করেননি।”

ওই সব গ্রামের প্রবীণেরাা জানাচ্ছেন, ৫০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন আরামবাগের ঘড়া শিল্প। অতীতে বড় বড় নৌকায় পিতলের বাট আসত। এখন অধিকাংশ কাঁচামাল হল বাতিল পিতল। কারিগরদের অধিকাংশই এখন মহাজনের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁরাই কাঁচামাল, কয়লা ইত্যাদি সরঞ্জাম দিচ্ছেন। মহাজনের পাওনা মিটিয়ে একটি ঘড়া থেকে মাত্র ১০-২০ টাকা লাভ হয়।

মানিকপাট গ্রামের ঘড়া-কারিগর সুনীল পরামাণিক, স্বপন দাস বা রায়পুর গ্রামের প্রশান্ত দাস, ফকির জানাদের অভিযোগ, শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পঞ্চায়েত এবং ব্লক স্তরে বহু আবেদন-নিবেদন করা হয়েছে। মাঝে মাঝে শিল্পের হাল খতিয়ে দেখতে আসেন ব্লক এবং জেলা শিল্প দফতরের আধিকারিকরা। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয় না।

প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, শিল্পটিকে বাঁচানোর জন্য গোঘাটের বালি এলাকায় প্রায় এক বিঘা জমিতে কেন্দ্র সরকারের প্রকল্প ‘কমন ফেসিলিটি সেন্টার’ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় ২০১২ সাল নাগাদ। অর্থ বরাদ্দ হয় প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ খরচ কেন্দ্রের, ২০ শতাংশ রাজ্য সরকারের এবং ১০ শতাংশ কারিগরদের দেওয়ার কথা ছিল। ওই কেন্দ্র থেকেই কাঁচামাল, জ্বালানি হিসাবে বিদ্যুত্‌ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম মিলত।

আরামবাগ এবং গোঘাটের যুগ্ম দায়িত্বে থাকা ব্লক শিল্প উন্নয়ন আধিকারিক প্রভাতকুমার ঘোষ জানান, মাটির তৈরি ছাঁচের জায়গায় ধাতুর ছাঁচ এবং কয়লার বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বিদ্যুত্‌ ব্যবহার চালু করা গেলে শিল্পের সঙ্কট অনেকটাই কাটত। কিন্তু জমির অভাবে ওই কেন্দ্র গড়া যায়নি। কারিগররা সমবায় নিয়েও উত্‌সাহ দেখাননি।

শিল্পটির সঙ্গে যুক্ত সবচেয়ে প্রবীণ সন্তোষ রানা অবশ্য দাবি করেছেন, সমবায় গড়ার জন্য তাঁরা উদ্যোগী হয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁর ক্ষোভ, “কমন ফেসিলিটি সেন্টারের স্বপ্ন দেখানো হয়েছে মাত্র। আমাদের জমি জোগাড় করতে বলা হয়েছিল। আমরা জমি কোথায় পাব? আমরা তো ব্যাঙ্কের ঋণও পাই না।”

তবে, চাপান-উতোরের মধ্যেও সকলেই চান, শিল্পের মরা গাঙে দ্রুত জোয়ার আসুক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement