নৌকায় বাওড় পেরিয়ে তেরো ঘরের পথে বিজেপি প্রার্থী কেডি বিশ্বাস। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
মূল ভারতীয় ভূখণ্ড কালিয়ানি থেকে জলপথে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগবে তেরো ঘরে পৌঁছতে। ৮টি পরিবারের ৫০ জন থাকেন সেই ভারতীয় ছিট মহলে। বুধবার সকালে সেখানেই নৌকা করে প্রচারে গেলেন বিজেপি প্রার্থী কেডি বিশ্বাস।
কালিয়ানি থেকে পেট্রাপোল পিরোজপুর বাওড় পেরিয়ে যেতে হয় তেরো ঘরে। তিন দিকে বাংলাদেশের গাঁতিপাড়া, দৌলতপুর সীমান্ত দিয়ে ঘেরা ওই ছিটমহলটি বনগাঁর ছয়ঘরিয়া পঞ্চায়েতের অধীন। মূল ভূখণ্ড থেকে যাওয়ার জন্য এক মাত্র নৌকাই ভরসা। প্রতিটি পরিবারেরই রয়েছে একটা করে নৌকা। বাওড়ের জলে মাছ ধরা বা মূল ভূখণ্ডে গিয়ে অন্যের জমিতে চাষ করা ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই জীবিকা বলতে। ভোর হতেই বাওড় পেরিয়ে জয়ন্তীপুর বাজারে গিয়ে মাছ বিক্রি করাই ভরসা এখানকার মানুষের। তার জন্য প্রয়োজন হয় বিএসএফের অনুমতির। মহিলারা সচরাচর বেরোন না। নিরাপত্তার জন্য এক দিন অন্তর গ্রামে যান বিএসএফ জওয়ানেরা। তার মধ্যে আবার বাওড়ের জল শুকিয়ে গেলে মাছের আকালও দেখা যায়। সব মিলিয়ে ছোট্ট এক ফালি ওই ছিট মহলে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট।
বুধবার গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, অনেক বাড়িতে তখনও উনুন জ্বলেনি। কারও বাড়িতে ভাতের সঙ্গে তরকারি বলতে শুধুই শাক। মাটির বাড়ির উপর টালি বা টিনের ছাউনি। অনেকের আবার বাড়ির দেওয়াল বলতে বাঁশের বেড়া। উন্নয়নের চিহ্ন বলতে শুধু একটা জলের কল। তবে আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল মেলে না। নেই বিদ্যুৎও। পড়াশোনার জন্য বাওড় পেরিয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদের যেতে হয় মূল ভূখণ্ডের ঠাকুর হরিদাস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ও নরহরিপুর সারদাচরণ বিদ্যাপীঠে। গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ধরে প্রশাসনের কাছে পুনর্বাসনের দাবি জানালেও কোনও লাভ হয়নি। গৌর হালদার নামে এক বৃদ্ধ বলেন, “অন্যত্র যাওয়ার কোনও উপায় নেই। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে জানিয়েছি পুনর্বাসনের জন্য। কিন্তু লাভ হয়নি। তাই বলাই ছেড়ে দিয়েছি।”
শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কোনও সুবিধাই তাঁরা পান না বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। ইন্দিরা আবাস যোজনা প্রকল্পে বাড়ি পাননি কেউ। মেলে না বিধবা ভাতাও। ঘিন্না হালদার নামে এক বৃদ্ধা বলেন, “আমার মা নব্বই বছর বয়সে কিছু দিন আগে মারা গিয়েছেন। কোনও বিধবা ভাতা পাননি। সেটাই তাঁর খুব আফশোস ছিল।” ওই ছিটমহলের বাসিন্দা শেফালি হালদারের বাপের বাড়ি ছিল পিরোজপুরে, মূল ভূখণ্ডে। তাঁর স্বামী কালিদাসবাবু কালিয়ানিতে অন্যের জমিতে চাষ করেন। শেফালিদেবী বলেন, “পঁচিশ বছর হল বিয়ে হয়ে এসেছি। এখানে থাকাটাই সব চেয়ে বড় সমস্যা।” বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সরকার যদি তাঁদের জমি নিয়ে আর্থিক ভাবে সাহায্য করে বা জমির বিনিময়ে অন্যত্র পুনর্বাসন দেয় তবে তাঁরা তা নিতে প্রস্তুত।
প্রতিশ্রুতি রাখেননি কেউই। অথচ প্রতি বছরই নৌকা করে বাওড় পেরিয়ে পিরোজপুরে ভোট দিতে যান এই মানুষগুলো। বললেন, “এই প্রথম কোনও বিজেপি প্রার্থী এলেন এখানে। আগে তৃণমূল, সিপিএম অনেক দল এসেছে। প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কথা রাখেনি। অথচ ভারতের নাগরিক হিসেবে প্রতি বার ভোট দিই আমরা। ২০০৯-এর লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূলের গোবিন্দচন্দ্র নস্কর এসে বলেছিলেন আমাদের সমস্যা তুলে ধরবেন কেন্দ্রের কাছে। কিন্তু তার পর থেকে তিনি আর খোঁজ নেননি।”
যদিও স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাসের ব্যাখ্যা, “গোবিন্দবাবু কেন্দ্রে বিষয়টি তুলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে তিনি দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকায় বিষয়টা নিয়ে আর এগোতে পারেননি। আমি এর মধ্যেই ওই এলাকায় যাব ও ওখানকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলে পরিকাঠামোর সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করব।”
এ দিন ১০ জন কর্মী সমর্থক নিয়ে নৌকায় ওই এলাকায় গিয়েছিলেন কেডি। সঙ্গে ছিলেন পাঁচ জন বিএসএফ জওয়ান। বাসিন্দাদের উদ্দেশে কে ডি বলেন, “ওপারেই আমার বাড়ি। দরকার হলে চলে যাবেন। মোদী আসছেন দিল্লিতে। জিতলে আপনাদের সমস্যা নিয়ে অবশ্যই কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে কথা বলে সমাধানের চেষ্টা করব।” কেডিকে দেখতে ভিড় জমে যায় বাংলাদেশ সীমানায়। গ্রামের ভিতরে বিজেপির পতাকা টাঙিয়ে দেন কর্মীরা। হাত মেলান বিজিবি-এর দুই জওয়ানও। প্রায় এক ঘণ্টা ছিট মহলে কাটিয়ে নৌকা করে মূল ভূখণ্ডে ফিরে আসেন কেডি।