মঞ্চে বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী ছিলেন বলেই কি এড়িয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা! নিজস্ব চিত্র।
ব্যবধান প্রায় দেড় বছরের। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পর হাওড়া স্টেশন। আবার ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান। দু’টি ক্ষেত্রেই উপস্থিত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে প্রথমটিতে মোদী সশরীরে হাজির ছিলেন। দ্বিতীয়টিতে তিনি উপস্থিত ছিলেন ‘ভার্চুয়ালি’। কিন্তু সেই কর্মসূচিতে ভাষণ দিতে গিয়ে মোদী এবং মমতা দু’জনেই স্লোগান প্রসঙ্গ এড়িয়েই গেলেন।
হাওড়া স্টেশনে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান শুনে দৃশ্যতই রুষ্ট মমতা মঞ্চে উঠতে অস্বীকার করেন। মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়েই বক্তৃতা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তৃতার বেশ খানিকটা জুড়ে ছিল সদ্য মাতৃহারা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সমবেদনা। আর প্রধানমন্ত্রীর গলায় শোনা গেল বাংলার মানুষের প্রশংসা। শোনা গেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কলি— ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার প’রে ঠেকাই মাথা’।
দুই শিবিরের দুই যুযুধান স্লোগান প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা বলে তা নিয়ে জল্পনা এবং আলোচনা থামছে না। পাশাপাশি এই আলোচনাও শুরু হয়েছে যে, ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে মঞ্চে না-উঠে মমতা ঠিক করলেন না ভুল করলেন! অনেকে অবশ্য বলছেন, ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান নয়, আসলে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে এক মঞ্চে থাকবেন না বলেই মমতার এই পদক্ষেপ। কারণ, শুভেন্দু যে ভাবে মমতাকে আক্রমণ করে থাকেন (শুক্রবারেও করেছেন), তা ‘শিষ্টাচারবিরোধী’ বলেই মনে করেন মমতার ঘনিষ্ঠেরা। সেই শুভেন্দুর সঙ্গে মমতার একই মঞ্চে থাকা নিয়ে একটা কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। সে কারণেই ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানকে সামনে রেখে মমতা শুভেন্দুর সঙ্গে একই মঞ্চে উপস্থিতি এড়িয়ে গিয়েছেন। যদিও এই তত্ত্বের কোনও আনুষ্ঠানিক সমর্থন মেলেনি।
অনেকে বলছেন, ওই স্লোগান শুনে মমতার এত ধারালো প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত হয়নি। তিনি শান্ত ভাবে শুনে মঞ্চে উঠেই বক্তৃতা করতে পারতেন। বক্তৃতায় স্লোগান দিতে ব্যস্ত বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের একহাত নিতে পারতেন এই বলে যে, ‘‘আপনারা শুধু শ্রীরামের জয়ধ্বনি দিচ্ছেন কেন? আপনারা তো জয় সিয়ারাম বলতে পারেন! আপনারা কেন সীতাকে রামের থেকে আলাদা করছেন?’’ যেমনটা বলেছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। এমনকি, মমতা নিজেও বলেছিলেন কয়েক মাস আগে বারাণসী সফরে গিয়ে। বস্তুত, এই মতামতের প্রবক্তারা বলছেন, ‘জয় শ্রীরাম’ শুনে মমতা যে ভাবে ‘রুষ্ট’ হচ্ছেন, তাতে তাঁর হিন্দু ভোট পাওয়ার প্রচেষ্টা কোথাও না কোথাও ধাক্কা খেলেও খেতে পারে।
পক্ষান্তরে অন্য একাংশের বক্তব্য, যে ভাবে বিজেপি মমতাকে লক্ষ্য করে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে তাঁকে ক্রমাগত হেনস্থার চেষ্টা করছে, তা বাংলার মানুষ ভাল চোখে দেখছেন না। যেমন তাঁরা ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের প্রচারে এসে মোদীর বার বার সুর করে মমতাকে ‘‘দিদি, ও দিদি’’ বলে খানিকটা ব্যঙ্গ করার চেষ্টাকেও দেখেননি। এই গোটা প্রচেষ্টায় আখেরে বিজেপির খুব উপকার হবে না বলেই মনে করছে ওই অংশ।
শুক্রবার কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও মঞ্চে পা রাখেনননি মমতা। তবে অনুষ্ঠানস্থল ছেড়ে চলেও যাননি। মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়েই তিনি বক্তৃতা করেন। ভাষণে বার বার প্রধানমন্ত্রীকে সমবেদনা জানান। নিজের মায়ের প্রসঙ্গও তুলে এনে মমতা বলেন, ‘‘আজ আপনার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে অত্যন্ত দুঃখ এবং অপূরণীয় ক্ষতির দিন। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আপনাকে কাজ এবং প্রচেষ্টার মাধ্যমে মায়ের প্রতি ভালবাসা প্রকাশের শক্তি দেন।’’
কলকাতার কর্মসূচিতে আসতে চাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মায়ের শেষকৃত্যের পরেই মোদীকে যোগ দিতে হয়েছে ‘বন্দে ভারত’ এক্সপ্রেস উদ্বোধনের কর্মসূচিতে। সেই প্রসঙ্গে মমতার পরামর্শ, ‘‘আপনাকে বিশ্রাম নিতে বলব।’’
তবে মমতা-মোদী নীরব থাকলেও ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান এবং তৎপরবর্তী সময়ে মমতার প্রতিক্রিয়া মনে করিয়ে দিয়েছে ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিবসে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের একটি অনুষ্ঠানের কথা। সেখানে মমতা বক্তৃতা শুরু করার পরেই দর্শকাসন থেকে একই ভাবে উঠেছিল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী পোডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে বলেছিলেন, ‘‘আমার মনে হয়, সরকারি অনুষ্ঠানের একটা শালীনতা থাকা উচিত। এটা কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি নয়। এটা সমস্ত দলেরই কর্মসূচি। জনতার কর্মসূচি।’’ এর পর বক্তৃতা না দিয়েই তিনি নেমে গিয়েছিলেন মঞ্চ থেকে। এ বার অবশ্য তিনি ভাষণ দিয়েছেন। সেখানে ‘জয় শ্রীরাম’ নিয়ে কোনও কথাই উচ্চারণ করেননি।
ভার্চুয়াল মাধ্যমে সবুজ পতাকা নেড়ে হাওড়া-নিউ জলপাইগুড়ি ‘বন্দে ভারত’ এক্সপ্রেসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধনের পরেই রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস, মুখ্যমন্ত্রী মমতা, কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী-সহ উপস্থিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুকে ‘প্রণাম’ জানিয়ে নিজের ভাষণ শুরু করেন মোদী। জানান, তাঁরও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু ‘ব্যক্তিগত কারণে’ আসতে পারেননি। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলা এবং কলকাতার পবিত্র মাটিকে আমার প্রণাম জানাই। যেই মাটিতে বন্দে মাতরম গানের জন্ম, সেখানেই শুক্রবার সবুজ পতাকা দেখিয়ে বন্দে ভারত ট্রেনের সূচনা করা হল।’’
এর পরেই নেতাজি এবং স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির প্রসঙ্গ তুলে মোদী বলেন, ‘‘১৯৪৩ সালে আন্দামানে তেরঙ্গা তুলে নেতাজি স্বাধীন ভারতের ঘোষণা করেছিলেন। তার ৭৫ বছর পূর্তিতে ২০১৮ সালে আন্দামানে গিয়ে নেতাজির নামে একটি দ্বীপের নামকরণ করেছিলাম।’’ এই সূত্রেই স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে ‘বন্দে ভারত’ ট্রেন চালুর কথা মনে করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘এখন দেশ স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন করছে। এর অধীনে ৪৭৫টি বন্দে ভারত ট্রেন চালুর সঙ্কল্প করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তার মধ্যে একটি হাওড়া-নিউ জলপাইগুড়ি বন্দে ভারত এক্সেপ্রেস।’’