ভাল নম্বরের জন্য লড়তে হয় সব পড়ুয়াকেই। অন্যদের মতো লড়েছেন ওঁরাও। তবে ওঁদের লড়াইটা আর-পাঁচ জনের থেকে অনেক বেশি কঠিন। তবু দারিদ্র বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কিংবা শোকতাপ ওঁদের দৌড় থামাতে পারেনি। জিতেছেন ওঁরা। তবে ওঁরা জানেন, পথে পথে পাথর ছড়ানো। জানেন, আগামী লড়াইটা কঠিনতর। আসল লড়াই সেটাই।
বাবা-মাকে দেখে
আসানসোলের মহীশিলা বটতলা বাজারে বাবার ছোট্ট রুটি-তরকারির দোকান। মাকে নিয়ে সেটা চালান বাবা। সেই দোকান থেকেই টেনেটুনে চলছে সংসার। সকাল-সন্ধে মা-বাবাকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে দেখেই জেদটা চেপে গিয়েছিল আসানসোল ইস্টার্ন রেল স্কুলের ছাত্র কৌশিক দাসের। দোকানের বাসি রুটি-তরকারি বা ভাত খেয়েই স্কুলে দৌড়েছেন তিনি। পেয়েছেন ৯৩ শতাংশ নম্বর। আসানসোলের কোনও কলেজে হিসেবশাস্ত্রে অনার্স নিয়ে পড়তে চান তিনি। হতে চান চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। কিন্তু চিন্তা একটাই, উচ্চশিক্ষার খরচ জুটবে কী ভাবে? বাবা পঙ্কজ দাস বলছেন, ‘‘ছেলের লড়াই যাতে কোনও ভাবেই থেমে না-যায়, তার জন্য আমরা আরও পরিশ্রম করবো। কৌশিককে বড় হতেই হবে।’’ কৌশিক বলেন, ‘‘বাবা-মাকে
দেখেই আমি লড়াইয়ের সাহসটা পেয়েছি। এই সাহসটাই আমার ভবিষ্যতের পাথেয়।’’
মিষ্টির মজুর
ভাল কলেজে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু পয়সা নেই। তাই উচ্চ মাধ্যমিকে ৮৬ শতাংশ নম্বর পাওয়া পুরুলিয়ার বোরো হাইস্কুলের পড়ুয়া ফুলচাঁদ কুম্ভকার এখন মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরে মিষ্টির দোকানে দৈনিক দেড়শো টাকা মজুরিতে কাজ করতে গিয়েছেন। তাই মার্কশিট তোলা হয়নি এখনও। ফুলচাঁদের মা মালতী কুম্ভকার বলেন, ‘‘আমি একশো দিনের প্রকল্পে কাজ করি। ছেলে মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে কাজ করেছে। এ বার পরীক্ষা দেওয়ার পরে বলল, ‘মা, কলেজে পড়ার খরচ অনেক। তাই বাইরে গিয়ে কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ি ফিরবো।’ এক আত্মীয়ের সঙ্গে সে এখন বিলাসপুরে রয়েছে। ২২ মে বাড়ি ফিরবে।’’ মানবাজার দু’নম্বর ব্লকের বিডিও নির্মল চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এক জন মেধাবী ছাত্র আর্থিক কারণে অন্য রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করে কলেজের পড়ার খরচ জোগাড় করবে, এটা ভাবা যায় না। আমি ওই ছেলেটির স্কুলের সঙ্গে কথা বলছি। ওর উচ্চতর শিক্ষার জন্য সরকারি স্তরে কী ভাবে সাহায্য করা যায়, দেখছি।’’
স্বপ্নার স্বপ্ন
ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। মা পাঁপড়ের কারখানায় কাজ করেন। সেই রোজগারে সংসার চালানোই মুশকিল, তার উপরে পড়াশোনার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে ৮৯ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন ইসলামপুরের স্টেট ফার্ম কলোনি হাইস্কুলের ছাত্রী স্বপ্না রায়। বাবা নির্মল রায় ছিলেন রাজমিস্ত্রি। মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে টিনের চালা আর ইটের গাঁথনির একটি আস্তানা। বাবাই করে দিয়ে গিয়েছেন। সেটিই তাঁদের আশ্রয়। স্বপ্নার বড় দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এক দিদি স্নাতকোত্তর পড়ছেন। দাদা কলকাতায় পড়েন। স্বপ্না বললেন, ‘‘মায়ের সঙ্গে সঙ্গে দিদিদেরও সব সময় পাশে পেয়েছি।’’ পড়ার খরচ চলবে কী ভাবে? ‘‘তেমন হলে ছাত্র পড়িয়ে নিজের পড়ার খরচ জোগাড় করবো।’’ কলেজে পড়ানোর স্বপ্ন দেখেন স্বপ্না। মা সাধনা রায় বলেন, ‘‘ওদের বাবার স্বপ্ন ছিল, ওরা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। খুব কষ্ট করেই ওদের পড়াচ্ছি। ও যত দূর পড়তে চায়, পড়াবো।’’
অলরাউন্ডার
জলপাইগুড়ির রায়কতপাড়ার শনিমন্দির সংলগ্ন রাস্তার ধারে ঝুপড়ির বাসিন্দা আকাশ পাসোয়ান অলরাউন্ডার। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল থেকে এ বার উচ্চ মাধ্যমিকের কলা বিভাগে ৮৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন। এই আকাশকেই আবার জুনের মাঝামাঝি কলকাতায় দেখা যাবে। রাজ্য ব্যাডমিন্টন সিনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে জলপাইগুড়ি জেলার প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। বাবা গৌরীশঙ্কর দিনমজুর। মাঝেমধ্যে রাতে কোথাও পাহারা দেওয়ার ডাক পড়লে সেই কাজও করেন। আকাশ বলেন, “বাবার একটাই ইচ্ছে। আমরা দু’ভাই ভাল ভাবে পড়াশোনা করি। কষ্টের মধ্যেও আমার জন্য গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন।’’ আর ব্যাডমিন্টন? আকাশ বলেন, ‘‘অনুপ্রেরণা আমার মা। বলেকয়ে জলপাইগুড়ি ইন্ডোর গেমস প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনে ভর্তি না-করালে আমার খেলাটাই হতো না।” উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টের আগে পর্যন্ত আকাশ সন্ধ্যায় নিয়মিত অনুশীলন করে গিয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে আবার অনুশীলন শুরু করেছেন। এখন রাজ্য চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য মনোযোগ দিয়ে অনুশীলন করছেন।
লক্ষ্য শিক্ষকতা
বর্ষা খাঁ পেশায় ঢাকি। এখন ঢাক বাজানোর বরাত তেমন আসে না। তাই দিনমজুরি করেই কোনও মতে সংসার চালান তিনি। নিজেদের জমি নেই। স্ত্রী রিনাদেবী লোকের বাড়িতে রান্নার কাজ করেন। বর্ষা-রিনার ছেলে কার্তিক খাঁ পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরের তোড়িয়া হাইস্কুল থেকে এ বার ৭৯ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন। বড় হয়ে শিক্ষক হতে চান কার্তিক। বললেন, “জানি, সব সময় ইচ্ছেপূরণ হয় না। তবু চেষ্টা করছি। কিছু একটা হবেই। বাবা-মায়ের জন্যই পড়াটা চালিয়ে যেতে হবে।”
স্কুলই কান্ডার
বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন। ভবঘুরে। মায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু শৈশবেই। বাড়ি বলতে স্কুলের ছাত্রাবাস। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম ব্লকের নয়াগ্রাম বাণী বিদ্যাপীঠ থেকে ৮৪ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন তাপস হাটুই। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিকাশকুমার মণ্ডল বললেন, ‘‘দারিদ্রের কথা জেনে পঞ্চম শ্রেণি থেকেই ওর যাবতীয় পড়াশোনার খরচ আমরা মকুব করে দিয়েছি। স্কুলের শিক্ষকদের সাহায্যেই পড়াশোনা করেছে ও। গৃহশিক্ষক ছিল না।’’ তাপস বলেন, ‘‘একশো দিনের প্রকল্পে কাজ করে হাতখরচ জোগাড় করি। পড়ার বই স্যারেরা দিয়েছেন। কিন্তু এর পরে কী হবে, জানি না।” স্নাতক স্তরে ভূগোল নিয়ে পড়তে চাইছেন তাপস। হতে চান আবহবিদ। হবে কি তাঁর স্বপ্নপূরণ?
বাবার চ্যালেঞ্জ
বাড়ির সামনে সায়া-ব্লাউজের ছোট্ট গুমটি দোকান। মাসে মেরেকেটে হাজার তিনেক টাকা আয়। পাড়ার কয়েক জন মিলে বিনা খরচে পড়িয়েছেন। তার ফলও মিলেছে। কলকাতার পূর্ব পুটিয়ারি এলাকার ছোট্ট বাড়িতে অর্থকষ্টের মধ্যেও উচ্চ মাধ্যমিকে ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন অর্ঘ্য আচার্য। গঙ্গাপুরী শিক্ষা সদনের ওই পড়ুয়া বললেন, ‘‘পাড়ার কয়েক জন এবং পরিবার পাশে থাকায় পড়াশোনা করতে পেরেছি। সিএ পড়তে চাই। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে অর্থাভাব।’’ অর্ঘ্যের বাবা অজয়বাবু অবশ্য অনটনকে ভয় পাচ্ছেন না।
বললেন, ‘‘ছেলেকে পড়ানোটাই আমার কাছে চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ নিতে আমি তৈরি।’’