কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম। — ফাইল চিত্র।
রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে পাঁচ দফা আবেদন জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বিজেপির আইনজীবী শ্রীজীব চক্রবর্তী এবং কংগ্রেসের আইনজীবী কৌস্তুভ বাগচী। প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম জনস্বার্থ মামলার অনুমতি দিয়ে দ্রুত শুনানির সিদ্ধান্ত নেন শুক্রবার সকালে। দুপুরেই মামলার শুনানি হয় প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চে। রাজ্যের তরফে মামলার শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী ছিলেন জিষ্ণু সাহা।
জনস্বার্থ মামলায় হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ:
পঞ্চায়েত ভোটে প্রায় ৭৫ হাজার আসনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য ৫ দিন সময় কম বলে মনে করছে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে মনোনয়ন থেকে ভোটগ্রহণ পুরো সময়টি অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে করা হয়েছে। মনোনয়নে সময় খুবই কম দেওয়া হয়েছে। ভোটের নির্ঘণ্ট নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে পারে কমিশন। মহকুমাশাসক, জেলাশাসক বা কমিশনের অফিসে মনোনয়ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখতে হবে। হাই কোর্টের নির্দেশ, এই বিষয়গুলি নিয়ে কমিশন নিজেদের বক্তব্য জানাবে। ভোটগ্রহণ থেকে গণনা গোটা প্রক্রিয়া সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারিতে করা ভাল।
ভোটের কাজে অস্থায়ী কর্মী বা সিভিক ভলান্টিয়ারদের ব্যবহার নিয়ে আদালতের আগে কোনও নির্দেশ থাকলে তা মেনে চলতে হবে। ভোট সংক্রান্ত কোন কোন কাজে সিভিকদের ব্যবহার করা যাবে, তা নিয়ে এর আগে বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার একটি নির্দেশ ছিল। রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে বিচারপতি মান্থার ওই নির্দেশ মেনে পদক্ষেপ করতে বলেছে কলকাতা হাই কোর্ট। তবে পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবহার করা হবে কি না, সে বিষয়ে রাজ্য সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে হাই কোর্ট।
কী হল মামলার শুনানি পর্বে?
কল্যাণ: রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এর আগে দেখা গিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে হস্তক্ষেপ করেনি।
প্রধান বিচারপতি: আমরা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য শুনতে চাই। মামলায় একাধিক আবেদন করা হয়েছে। তা নিয়ে তাদের অবস্থান প্রথমে জানা দরকার।
গুরু কৃষ্ণকুমার (বিজেপির আইনজীবী): আমাদের বেশ কয়েকটি আবেদন রয়েছে। মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য মাত্র ৫ দিন সময় কেন? এত তাড়াহুড়োর কী রয়েছে? অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বা কোনও বিশেষ অফিসারকে দিয়ে এই ভোটের উপর নজরদারি করা হোক। সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য মোতায়েন করা হোক কেন্দ্রীয় বাহিনী। ভোটগ্রহণ থেকে গণনা পর্যন্ত সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবহার করা উচিত। অনলাইনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।
জিষ্ণু: আমরা সব বিষয়টিই নজরে রাখছি। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।
প্রধান বিচারপতি: সিসিটিভি ক্যামেরা নিয়ে কী অবস্থান? এখন তো বার অ্যাসোসিয়েশনও ক্যামেরার নজিরদারিতে। তা হলে এত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে কেন সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহার নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেই কমিশনের? প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়েছে। পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্যামেরার নজরদারি করা প্রয়োজন বলে মনে করি। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব।
মনোনয়নে এত কম সময় কেন? এত আসনে মনোনয়ন জমা দিতে হবে। ফলে বিষয়টি তো কমিশনের চিন্তা করা প্রয়োজন। পঞ্চায়েতের মেয়াদ কবে শেষ হচ্ছে?
কল্যাণ: অগস্টে মেয়াদ শেষ হচ্ছে। জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। তার পরে এক মাস সময় লাগে।
প্রধান বিচারপতি: পুরো প্রক্রিয়াটিতে তাড়াহুড়ো মনে হচ্ছে!
কল্যাণ: ২০১৮ সালে কমিশনের সিদ্ধান্তের উপর কোনও হস্তক্ষেপ করেনি সুপ্রিম কোর্ট। শুধু ফলঘোষণার উপর নির্দেশ ছিল।
প্রধান বিচারপতি: বিষয়টি চিন্তাভাবনা করছি। মনোনয়ন নিয়ে কমিশনের অবস্থান কী?
জিষ্ণু: মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় কম বলা হচ্ছে, বাড়ানো যায় কি না তা জেনে এসে বলতে পারব।
কৌস্তুভ: পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তিকে আমরা চ্যালেঞ্জ করছি না। অনলাইনে মনোনয়ন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব দেখা যায়। মুর্শিদাবাদের রানিনগর এলাকার ক্ষেত্রে উদাহরণ দিতে পারি এমন ঘটনার।
কল্যাণ: ইলেকট্রনিক তথ্য গ্রহণযোগ্য নয়। অনলাইনে মনোনয়ন নিতে হবে বলে নিয়মে কোথাও নেই।
প্রধান বিচারপতি: অনলাইনে মনোনয়ন জমা নেওয়ায় কী অসুবিধা? অনলাইন হলে তো সুবিধা। কেউ সশরীরে যেতে না পারলে তিনিও মনোনয়ন দিতে পারবেন। স্ক্রুটিনি কত সহজ হয়ে যাবে। প্রযুক্তিতে আপনাদের এত এলার্জি কেন? নিয়ম আগে ছিল না বলে এখন হবে না এটা তো কোনও কাজের কথা নয়! এই হাই কোর্টেও তো অনেক কিছু আগে হয়নি। এখন হচ্ছে।
কৃষ্ণকুমার: সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে কী কী পদক্ষেপ করা হয়েছে তা প্রকাশ করুক কমিশন। মনোনয়নে মাত্র ৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তির দিন থেকে ন্যূনতম ১২ দিন সময় দেওয়া হোক।
প্রধান বিচারপতি: আগামী শুনানিতে (সোমবার এই মামলার পরবর্তী শুনানি) সব বিষয়েই বিবেচনা করা হবে। নির্বাচন কমিশন আগে রিপোর্ট জমা দিক।
আদালতের পর্যবেক্ষণ:
প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় খুবই কম। এত তাড়া কেন? এটি পুনর্বিবেচনা করা উচিত কমিশনের। ব্লক অফিস (বিডিওর দফতর) ছাড়াও অন্যত্র মনোনয়ন জমা দেওয়া যায় কি না দেখা হোক। এ নিয়ে আদালতে রিপোর্ট জমা দিতে হবে কমিশনকে।
সুষ্ঠু এবং শান্তিতে ভোটের জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা করা উচিত। পুলিশ না কি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানো হবে রাজ্য সেই সিদ্ধান্ত জানাক। নির্বিঘ্নে মনোনয়ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত।