ফাইল চিত্র।
ভাঁড়ারের দুর্দশার কথা নানা ভাবে নিরন্তর বলে চলেছে নবান্ন। অথচ যেখান থেকে ভূমিরাজস্ব বাবদ বছরে অনায়াসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আদায় হতে পারে, সেই কলকাতা শহরেই ওই রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা নেই! যদিও পশ্চিমবঙ্গের অন্য সর্বত্র ভূমিরাজস্ব দিতে হয় বাসিন্দাদের। রাজধানী শহর কলকাতায় (পুরসভার এক থেকে ১০০ নম্বর ওয়ার্ড) যে এক পয়সাও ভূমিরাজস্ব নেওয়া না, সেই বিষয়ে সরকারের তরফে তেমন উচ্চবাচ্য নেই বলেও প্রশাসনিক সূত্রের খবর। অথচ রাজ্য প্রশাসনেরই অন্দরের খতিয়ান অনুযায়ী খাস কলকাতায় বছরে ৩০০ কোটি টাকা ভূমিরাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত।
কলকাতায় ভূমিরাজস্ব না-নেওয়ার কারণ রাজ্যের অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের কাছেও স্পষ্ট নয়। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতা পুরসভার আলাদা আইন রয়েছে। এখানে বাড়ির কর নেওয়া হয়। কিন্তু ভূমিরাজস্ব নেওয়া হয় না কেন, ভাল ভাবে না-জেনে তা বলতে পারব না। অন্যান্য পুর এলাকায় বাড়ির করের পাশাপাশি ভূমিরাজস্ব কী হারে কতটা নেওয়া হয়, সেটাও দেখতে হবে।’’
বর্তমানে তীব্র অর্থসঙ্কটের দরুন বহু ক্ষেত্রে শুধু যে ব্যয়সঙ্কোচ করতে হচ্ছে, তা-ই নয়, কিছু ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অর্থও খরচ করতে পারছে না সরকার। ভাঁড়ারে টাকা নেই, কার্যত এই যুক্তি দেখিয়ে রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ বা মহার্ঘ ভাতাও দিতে পারছে না নবান্ন। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ অনুসারে ডিএ দিতে গেলে আর্থিক বিপর্যয় হতে পারে বলেও হলফনামায় জানিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী। কিন্তু প্রশাসনের একাংশের অনুযোগ, আয় বাড়ানোর চেষ্টা তো দূরের কথা, খাস কলকাতায় রাজস্ব না-নিয়ে কার্যত আরও লোকসানের পথে হাঁটছে সরকার!
প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, খাস কলকাতায় আবাসিকদের প্রতি ডেসিমেল জমিতে বার্ষিক ৪৫ টাকা এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রতি ডেসিমেল জমিতে বার্ষিক ২০০ টাকা ভূমিরাজস্ব দেওয়ার কথা। টাকার বিচারে বলা চলে, এই কর যৎসামান্য। অন্তত কলকাতার মতো মহানগরীর ক্ষেত্রে তো বটেই। কিন্তু সেটুকুও যদি আদায় করা না-হয়, সরকারের ভাঁড়ারে টাকা আসবে কোথা থেকে? প্রশাসনের যুগ্মসচিব পদের এক অফিসার বলেন, “আয় নেই, কিন্তু ব্যয়ের বহর বেড়ে চলেছে। কোষাগারে টাকা আসবে কোথা থেকে?”
ভূমি দফতর সূত্রের খবর, ২০০৩ সালে ‘কলকাতা ল্যান্ড রেভিনিউ অ্যাক্ট’ বা কলকাতা ভূমিরাজস্ব অনুসারে দর নির্ধারণ করা হয়েছিল। হাওড়া-সহ কেএমডিএ আওতাভুক্ত বিভিন্ন পুর এলাকায় তা রূপায়ণ করা হলেও খাস কলকাতায় হয়নি। সেই সময় কলকাতা পুরসভার সংযোজিত এলাকাগুলি ছিল না। তার ফলে বর্তমানে কলকাতা পুরসভার সংযোজিত এলাকার বাসিন্দারাও ওই কর দেন। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরে কলকাতায় ভূমিরাজস্ব আদায়ের আইন রূপায়ণের ফাইল তৈরি হয়েছিল এবং প্রশাসনের শীর্ষ স্তরে সেটি পাঠানোও হয়েছিল। কিন্তু ‘অজ্ঞাত’ কারণে সেই ফাইল আর নড়েনি বলেই সূত্রের দাবি।
রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর মকুবের ঘটনা নিয়ে বিরোধী শিবির প্রতিনিয়ত অনৈতিক খয়রাতির অভিযোগ তোলে। কোষাগারে টাকা না-থাকলেও যে-ভাবে খেলা, মেলার খাতে বিভিন্ন ক্লাবের মধ্যে টাকা বিলি করা হয়, তা নিয়েও বার বার অভিযোগ উঠছে। দুর্গাপুজোর জন্য রাজ্যের প্রতিটি ক্লাবকে সরকারের তরফে এ বার ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এই সব অনুদান নিয়ে বিতর্ক গড়িয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট পর্যন্ত। এমনকি, সরকার বিভিন্ন ধরনের সামাজিক প্রকল্পের নামেও ঘুরপথে টাকা বিলি ও খয়রাতি করে রাজ্যের আর্থিক বোঝা বাড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ। সেই সব প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে কিছু না-বললেও এ ভাবে কর মকুব করে আয় কমাতে থাকলে অচিরেই যে আর্থিক বিপর্যয় আসতে পারে, তা মেনে নিচ্ছেন কর্তাদের অনেকেই।