স্বাস্থ্যসাথী কার্ড করতে উপভোক্তাদের লাইন। ফাইল চিত্র।
আর যা-ই হোক, ডেঙ্গি লেখা যাবে না। অজানা জ্বর তবু লেখা যেতে পারে। খটোমটো দুর্বোধ্য কিছু লিখলেও অসুবিধা নেই।
প্রেসক্রিপশন, ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে এই অলিখিত ফতোয়ায় ফি বছর ডেঙ্গির বাড়বাড়ন্তের মরসুমে তটস্থ থাকেন চিকিৎসকদের বড় অংশ। তটস্থ কেন? তাঁদের এক জনের কথায়, ‘‘পাথরপ্রতিমায় বদলির ভয় কার নেই বলুন তো? ’’
করোনার কল্যাণে সেই ডেঙ্গি এখন দুধ-ভাত। কিন্ত করোনার ক্ষেত্রেও ‘ট্র্যাডিশন’ একই। ‘পজ়িটিভ’ হওয়া চলবে না। আর মৃত্যুর ক্ষেত্রেও করোনা নয়, বহু ক্ষেত্রে অন্য শারীরিক অসুস্থতাই যে ‘আসল’ কারণ, সেটা ‘মাথায় রাখতে হবে’!
চিকিৎসক মহলে এখন চালু কথা— ‘করোনাভাইরাসের আমদানি কি তৃণমূল সরকার করেছে? ডেঙ্গির মশারাও কি তৃণমূলের? তা যদি না হয়, তা হলে এত ঢাক ঢাক গুড় গুড় কিসের!’’ স্বাস্থ্য দফতরের এক আমলার ব্যাখ্যা, ‘‘উনি আসলে সবটাই বড় বেশি ব্যক্তিগত স্তরে নিয়ে যান। অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছেন দশ বছরে। কিছু হয়েছে, কিছু হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে না হওয়াগুলো প্রশাসনিক ব্যর্থতায়। আর কিছু ক্ষেত্রে কারও হাত থাকে না। কিন্তু উনি তা শুনবেন না। উনি চান, সবেতেই ১০০-য় ১০০ হবে। আর সেটা না-হলেই ঠারেঠোরে তথ্য চাপার ফরমান।’’
বস্তুত, গত এক দশকে এ রাজ্যে স্বাস্থ্যের অবস্থা বুঝতে গেলে গোড়াতেই এই কথাটা বুঝে নিতে হয়। বাম আমলের শেষ কয়েক বছর স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থমকে ছিল। কিছু আমলা এবং চিকিৎসকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু প্রকল্প সাফল্যের মুখ দেখেছিল ঠিকই। কিন্তু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি তেমন ছিল না। বরং না-থাকাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে গেলে তীব্র বিরোধিতাই জুটত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কাজের দিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে। কিন্তু সমালোচনা সহ্য করা বা তা থেকে শিক্ষা নেওয়া, এই দুই ক্ষেত্রে এই সরকারও পুরনো পথেই হেঁটেছে।
রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে অধুনা নতুন আঙ্গিকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে করোনা। বিশ্বব্যাপী যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে এই ভাইরাসকে ঘিরে, তার চাপ পড়েছে এ রাজ্যেও। সেই চাপ সামলানোর ক্ষেত্রে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বড় ভূমিকা ছিল। সেই কাজে রাজ্য অনেকটাই উত্তীর্ণ। এ রাজ্যের চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা যে ভাবে জীবনের ঝুঁকিকে তুচ্ছ করে পরিষেবা দিয়ে চলেছেন, সে জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। কিন্তু করোনা বেশ কিছু বড়সড় ফাঁকও দেখিয়ে দিয়েছে। হাসপাতালে শয্যা বাড়ানোই যে একমাত্র সমাধান নয়, রোগ নির্ণয়ের পরিকাঠামো বাড়ানো, গবেষণার ক্ষেত্র প্রস্তুত করাটাও যে খুবই জরুরি, সে কথা সরকার উপলব্ধি করেনি। পরীক্ষার সংখ্যা কমালে, তথ্য চেপে রাখলে রোগ তো সারেই না, উল্টে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়— এ কথা বোঝার জন্য যে দূরদর্শিতা প্রয়োজন, তা এই সরকারের কতটা রয়েছে, করোনা ফের সেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
যদিও ক্ষমতায় আসার পরে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কিছু কম নয়। প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে টাস্ক ফোর্স তৈরি হয়েছে। জেলায় জেলায় তৈরি হয়েছে সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিট, মাদার অ্যান্ড চাইল্ড কেয়ার হাব। বেড়েছে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব। চিকিৎসক সুব্রত মৈত্রের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে হাসপাতালগুলির পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য সুপারিশের তালিকাও তৈরি হয়েছিল। ক্যানসারের চিকিৎসার পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে কিছু জেলায়। কেমোথেরাপির দামি ওষুধ নিখরচায় মিলছে। কেনা হয়েছে আধুনিক যন্ত্র। সরকারি হাসপাতালে তৈরি হয়েছে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান। সেখানে ৬০ শতাংশ ছাড়েও ওষুধ মিলেছে। রোগীদের ‘আউট অব দ্য পকেট এক্সপেন্ডিচার’ কমেছে। মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা পরিকাঠামোর উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হলেও মানসিক হাসপাতালে রোগিণীদের নগ্ন করে রাখার মতো দুঃস্বপ্নের পরিস্থিতি পেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। তালিকাটা নেহাত ছোট নয়।
সরকারি হাসপাতালে সকলের জন্য নিখরচায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা। যদিও এখানে পাল্টা প্রশ্ন থেকেই যায়, যাঁদের সামর্থ্য রয়েছে, তাঁরা কেন ফ্রি চিকিৎসা পাবেন? সরকারি কোষাগারের হাল কি এতে আরও সঙ্গিন হয়ে পড়ছে না? জনমোহিনী সিদ্ধান্তের প্রলোভন এড়িয়ে একটু বিচক্ষণ কি হতে পারতেন না তিনি?
বিচক্ষণতার প্রশ্ন এসেছে জেলায় জেলায় সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল নিয়েও। ঝাঁ চকচকে বাড়ি তৈরি হয়েছে। কোটি কোটি টাকার যন্ত্র কেনা হয়েছে। কিন্তু ডাক্তার পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে দু’টি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, জেলায় যেতে চিকিৎসকদের উৎসাহিত হওয়ার কারণ নেই। কারণ, সেখানে তাঁদের থাকার উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরিতে সরকার কখনও পদক্ষেপ করেনি। পাশাপাশি, যে চিকিৎসকের বাড়ি যে জেলায়, তার কাছাকাছি তাঁদের পোস্টিং-এর বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তা করা হলে বহু চিকিৎসকই খুশি মনে জেলায় যেতে পারতেন।
বর্তমান সরকারের আমলে হাসপাতালে শয্যা বেড়েছে। মেডিক্যাল কলেজগুলিতে আসন বেড়েছে। কিন্তু তার পরেও প্রাথমিক স্তরে চিকিৎসার মান বাড়েনি। কমেনি রোগীদের কলকাতা-নির্ভরতা। জ্বর, পেট খারাপ নিয়েও কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ভিড় করেছেন বহু রোগী। এর পিছনে তাঁদের ‘কলকাতার সব ভাল’ জাতীয় মানসিকতা যেমন আছে, তেমনই আছে প্রাথমিক স্তরের স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যর্থতা। বস্তুত, এখনও নড়বড়েই রয়ে গিয়েছে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার ভিতটা। প্রাথমিক স্তরের পরিষেবার জন্য শুধুমাত্র ডাক্তারদের ওপরে নির্ভরশীল হওয়ার যে প্রয়োজন নেই, তা বোঝেনি এই সরকারও। প্রাথমিক স্তরের
স্বাস্থ্য পরিষেবা নার্স-প্র্যাকটিশনার দিয়েই অনেকটা চলতে পারত। প্রাথমিক চিকিৎসার পাঠ দিয়ে নার্সদের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিষেবা অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত। ঠিক যে ভাবে প্যারামেডিক্যাল কর্মী তৈরির উপরে জোর দেওয়া জরুরি ছিল। তাতে রোগ নির্ণয়টা হত, সুপার স্পেশ্যালিটিগুলিতে মূল্যবান যন্ত্র বাক্সবোঝাই হয়ে পড়ে থাকত না।
স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের জন্য রাজ্যের মানুষের তরফে সাধুবাদ অবশ্যই প্রাপ্য সরকারের। কিন্তু পাশাপাশি এই প্রশ্ন সচেতন রাজ্যবাসী তুলতেই পারেন যে, কেন্দ্রের আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে কেন ‘না’ বলা হল? এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হলে এক দিকে রাজ্যের আর্থিক ভার কমত, অন্য দিকে সাধারণ মানুষের বিমা-কভারেজও বাড়ত। স্রেফ রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে এই প্রকল্প থেকে সরে থাকাকে সরকারের ‘অদূরদর্শিতা’ বলেই মনে করেন অনেকে।
তবে এ কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অসহায় মানুষের কথা ভেবেছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলির শোষণ এবং যথেচ্ছাচার বন্ধে এই সরকারই প্রথম কড়া হাতে রাশ টানতে চেয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে হস্তক্ষেপ করেছেন একাধিক ক্ষেত্রে। তৈরি হয়েছে স্বাস্থ্য কমিশন। কিন্তু সমস্যা হল, ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে বহু ক্ষেত্রেই এক্তিয়ারের বাইরে পা ফেলেছে সরকার। অবাস্তব শর্ত চাপালে একাধিক হাসপাতাল এ রাজ্য থেকে পাততাড়ি গোটাতে পারে। হাততালি কুড়োতে গিয়ে ডাক্তার-বিরোধী কথা বলে লোক খেপালে তার জের সাধারণ মানুষকে পোহাতে হতে পারে, এ কথা বোঝার মতো পরিণতমনস্কতা মমতা দেখাতে পারেননি।
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে প্রথম পাঁচ বছরে সরকারের যে সদর্থক ভূমিকা ছিল, দ্বিতীয় দফায় তার মাত্রা অনেকটা কমে গিয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা মমতাই শুরু করেছিলেন, মাঝপথে তা থেকে তিনি নিজেই সরে আসেন। আর তাই স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্মসংস্কৃতি ফেরার যে স্বপ্ন তাঁর আমলে সাধারণ মানুষ দেখতে শুরু করেছিলেন, সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় অচিরেই। সাধারণ মানুষ আশা করেছিলেন, আউটডোরে ঠিক সময়ে ডাক্তার আসবেন। আশা করেছিলেন, ইমার্জেন্সিতে গেলে দীর্ঘ অপেক্ষার হয়রানি কমবে। ন্যায্য পাওনা আদায়ে দালাল ধরতে হবে না। জেলার মানুষ ভেবেছিলেন, সেখানকার মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ‘বড় ডাক্তারবাবুরা’ সপ্তাহে বড় জোর দু’-তিন দিন কাটিয়ে আর হয়তো কলকাতা ছুটবেন না।
নজরদারির প্রক্রিয়া শুরু হলেও এর কোনওটাই ধরে রাখা যায়নি। কঠোর হতে গিয়ে ডাক্তার মহলে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন বুঝেই হয়তো রাশ আলগা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর তাঁর রাশ আলগা হতেই দুর্ভোগের রোজনামচা ক্রমশ ফিরেছে আগের জায়গাতেই।