Dengue

এ বার ডেঙ্গির ভয় ঢুকছে উত্তরবঙ্গেও! দক্ষিণবঙ্গে তিন জেলার পর ‘হটস্পট’ চিহ্নিত হল হুগলিতেও

হুগলিতে শহরের তুলনায় গ্রামে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা, যা চিন্তা বাড়িয়েছে প্রশাসনের। এর মধ্যে নিষিদ্ধ ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনায়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:৩২
Share:

— প্রতীকী চিত্র।

পুজোর আগে রাজ্যে ভয় ধরাচ্ছে ডেঙ্গি। কলকাতার পাশাপাশি মশাবাহিত রোগের থাবা জেলাগুলিতেও। এমনকি, রেহাই পায়নি গ্রামাঞ্চলও। হুগলিতে শহরের তুলনায় গ্রামে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা, যা চিন্তা বাড়িয়েছে প্রশাসনের। কারণ শহরের মতো সেখানে চিকিৎসা পরিষেবা ততটা ভাল নয়। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার পর হুগলিতে চিহ্নিত হয়েছে ‘রেড জ়োন’। এর মধ্যে নিষিদ্ধ ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। স্বাস্থ্য দফতরের একটি সূত্র বলছে, সে কারণে ডেঙ্গিতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে পারে। ডেঙ্গির হাত প্রসারিত হয়েছে উত্তরেও। মালদহে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। একমাত্র দার্জিলিং এবং কোচবিহারে ডেঙ্গির প্রকোপ এখনও কিছুটা কম।

Advertisement

এত দিন দক্ষিণেই উদ্বেগ বাড়িয়েছিল ডেঙ্গি। এখন সে ছায়া ফেলল উত্তরেও। ডেঙ্গি জ্বরে কাবু মালদহ। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, মালদহ জেলার কালিয়াচকের ১, ২ এবং ৩ নম্বর ব্লক, রতুয়া ২ নম্বর ব্লকে ডেঙ্গির প্রকোপ সব থেকে বেশি। পাশাপাশি, ইংরেজবাজার ও পুরাতন মালদহ পৌরসভার বিভিন্ন এলাকাতেও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলির উপর চলছে নজরদারি। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে মালদহের যে সব এলাকায় ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা বেশি, সেখানে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। শহরের কিছু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও গ্রামীণ এলাকার বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডেঙ্গি পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে জেলার স্বাস্থ্য কর্মীদের ডেঙ্গির চিকিৎসার প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।

মালদহ জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জানুয়ারি মাস থেকে এখন পর্যন্ত ওই জেলায় ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১,০৩২ জন। গত এক মাসে মালদহে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৮৭ জন। গত সপ্তাহে শুধু ইংরেজবাজার শহরেই ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৪২ জন। তা ছাড়াও মালদহের কালিয়াচক ৩ নম্বর ব্লকে গত সপ্তাহে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৪ জন। মালদহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১০০ জন।

Advertisement

মালদহ জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুদীপ্ত ভাদুড়ি জানান, ডেঙ্গি নিয়ে যথেষ্ট সচেতন রয়েছে প্রশাসন। পুরকর্মীদের বৈঠকেও ডাকা হয়েছে। ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বলেন, ‘‘ডেঙ্গি মোকাবিলায় পুরকর্মীদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করা হয়েছে। আমাদের পুরকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমীক্ষা করছেন।’’ রাজ্য সরকারের দিকে এই নিয়ে আঙুল তুলেছে বিরোধী বিজেপি। ইংরেজবাজার পুরসভার বিরোধী দলনেতা অম্লান ভাদুড়ির কটাক্ষ, ডেঙ্গি মোকাবিলায় ব্যর্থ পুরসভা। ডেঙ্গি আক্রান্তের সঠিক পরিসংখ্যান গোপন করছে তারা।

স্বাস্থ্য দফতরের একটি সূত্র বলছে, গত তিন দিনের তুলনায় মুর্শিদাবাদে ডেঙ্গি পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। সরকারি হিসাবে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২০০০ ছাড়িয়েছে। তবে নতুন করে আক্রান্তের গ্রাফ নিম্নমুখী। জেলার অন্যতম ডেঙ্গি ‘হটস্পট’ লালগোলা, ভগবানগোলা এবং সুতি ব্লকে চলতি সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা গত সপ্তাহের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কম বলে জানা গিয়েছে। হটস্পট এলাকার হাসপাতালগুলিতে ভর্তি রোগীদের ‘মশারি’ বাধ্যতামূলক করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সরকারি হিসাব বলছে, নদিয়ায় চলতি বছরে আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যেই গত দু’বছরের থেকে বেশি। জেলার ১৮টি ব্লক ও ১০টি পৌরসভা এলাকায় দু’হাজারেরও বেশি ডেঙ্গি আক্রান্তের পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছে। ডেঙ্গির ‘হটস্পট’ রানাঘাট এবং হরিণঘাটা ব্লকে ডেঙ্গি মোকাবিলার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

উদ্বেগ বাড়ছে হুগলিতেও। জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, সেখানে ডেঙ্গিতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার ছাড়িয়েছে। সরকারি হাসপাতালে দেড়শোর বেশি ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগী ভর্তি। বেসরকারি হাসপাতালেও ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৭০ জন ভর্তি রয়েছেন। শহরের থেকে গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা, যা চিন্তা বাড়িয়েছে প্রশাসনের। বলাগড়, পাণ্ডুয়া, চণ্ডীতলাকে ‘রেড জোন’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়াকে ‘রেড জোন’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

দক্ষিণ ২৪ পরগনায় উদ্বেগ বাড়িয়েছে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া ওষুধ। অভিযোগ, হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে না গিয়ে অনেক রোগীই হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন। হাতুড়েদের পরামর্শে তাঁরা নিষিদ্ধ ওষুধ খাচ্ছেন, যা বিপদ ডেকে আনছে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, ৩৭তম সপ্তাহে বারুইপুর মহকুমায় ইতিমধ্যেই ডেঙ্গি আক্রান্ত ৬৫৩। এর মধ্যে রাজপুর-সোনারপুর পুরসভায় ১৪৫ জন আক্রান্ত, বারুইপুর পুরসভায় ২৪ জন আক্রান্ত, জয়নগর-মজিলপুর পুরসভায় ৪ জন আক্রান্ত। পাশাপাশি, বারুইপুর ব্লকে ১১৯ জন, জয়নগর ১ ব্লকে ১০৩ জন, জয়নগর ২ ব্লকে ৮৯ জন, কুলতলি ব্লকে ৫১ জন, সোনারপুর ব্লকে ২৮ জন, ভাঙড় ১ ব্লকে ৪১ জন, ভাঙড় ২ ব্লকে ৪৯ জন আক্রান্ত। অন্য দিকে, ক্যানিং মহকুমায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ১২১ জন। ক্যানিং ১ ব্লকে ৫৮ জন, ক্যানিং ২ ব্লকে ২৫ জন, বাসন্তীতে ২৫ জন, গোসাবায় ১৩ জন আক্রান্ত।

উত্তর ২৪ পরগনাতেও ডেঙ্গি নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। বনগাঁ, বাগদা, গাইঘাটা, বাদুড়িয়া, দক্ষিণ দমদম, বিধান নগর, হাবড়ায় লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, যে পরিমাণে প্রচার বা সচেতনতা শিবির প্রয়োজন ছিল, তা করছে না প্রশাসন। ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে তেমন সক্রিয়ও হয়নি প্রশাসন। ৩৭ সপ্তাহ পর্যন্ত ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা এই জেলায় প্রায় সাত হাজার। প্রশাসনের আশা, খুব শীঘ্রই নিয়ন্ত্রণে আসবে ডেঙ্গি। চরিত্রগত ভাবে ডেঙ্গি ভাইরাস অক্টোবর মাস পর্যন্ত সক্রিয় থাকে।

বাঁকুড়া জেলাতেও ঝোড়ো ব্যাটিং করছে ডেঙ্গি। ইতিমধ্যেই জেলায় ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ৩৬৩ জন। বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে পৃথক একটি ডেঙ্গি ওয়ার্ড খুলে চলছে চিকিৎসা। সব থেকে বেশি ডেঙ্গিতে আক্রান্ত বাঁকুড়া পুরসভা এলাকায়। স্বাস্থ্য দফতরের হিসাব অনুযায়ী, বাঁকুড়া পুর এলাকাতে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ৮০ জন। এ ছাড়াও রানিবাঁধ ব্লকে ৪৪ জন, খাতড়া ব্লকে ৩৮ জন এবং ওন্দা ব্লকে ৩২ জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত। স্বাস্থ্য দফতরের তরফে গ্রামে গ্রামে সচেতনতার কাজ চলছে। যে গ্রামে জ্বরের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে, সেখানে রক্তপরীক্ষার আয়োজন করা হচ্ছে।

ডেঙ্গি পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগামী মঙ্গলবার জরুরি বৈঠক ডেকেছে হাওড়া পুরসভা। সকল বিধায়ক, জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক এবং পুরসভার বোর্ড সদস্যরা উপস্থিত থাকবেন বৈঠকে। জানুয়ারি থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত হাওড়া পুর এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ৭১১ জন। উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড। শুধুমাত্র এই ওয়ার্ডে ২১০ জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত। পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান সুজয় চক্রবর্তী জানান, এ বছর ডেঙ্গিতে কেউ মারা যাননি। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর আক্রান্তের সংখ্যা সামান্য বেশি।

উত্তরেও কিন্তু পড়ছে আশঙ্কার ছায়া। রবিবার পর্যন্ত কোচবিহারের এমজেএন মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে কোনও ডেঙ্গি রোগী ভর্তি হননি। তবে জ্বর থাকায় ৩০ থেকে ৪০ জনের রক্ত পরীক্ষা করানো হয়েছে। রিপোর্ট আসেনি। তবে জেলা স্বাস্থ্য দফতরের আশঙ্কা, বৃষ্টির ফলে বিভিন্ন জায়গায় জল জমতে শুরু করেছে। সেখানে জন্মাতে পারে ডেঙ্গির মশা। এ বিষয়ে মেডিকেল কলেজের সুপার রাজীব প্রসাদ বলেন, ‘‘ডেঙ্গি নিয়ে ইতিমধ্যেই চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কোনও রোগীর ডেঙ্গি ধরা পড়লে সরকারি নির্দেশিকা মেনে তাঁর চিকিৎসা করাচ্ছি। প্রয়োজনে দিনে দু’বার করে প্লেটলেট টেস্ট করানো হচ্ছে।’’

দার্জিলিংয়ে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ডেঙ্গি। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তুলসী প্রামাণিক বলেন, ‘‘গত বছর জানুয়ারি মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৭০০ জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এ বছর জানুয়ারি থেকে এখনও পর্যন্ত গোটা জেলায় প্রায় ২০০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। সক্রিয় রোগীর সংখ্যা এখন নয় থেকে ১০।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement