হীরাঝিল বাঁচানোর উদ্যোগে শামিল এলাকার কচিকাঁচারাও। নিজস্ব চিত্র।
ভেঙে পড়েছিল কয়েকশো বছর আগেই। তার পর ভাগীরথীর গ্রাসে চলে যায় কিছু অংশ। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার সাধের সেই হীরাঝিল প্রাসাদের শেষটুকু টিকিয়ে রাখতে এ বার পথে নেমেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেই আন্দোলনের সঙ্গী হয়েছেন অভিনেত্রী সমর্পিতা দত্ত এবং নিহত নবাবের বাংলাদেশবাসী বংশধরেরা।
নবাবি আমলে এই মুর্শিদাবাদই ছিল বাংলা-বিহার-ওড়িশার রাজধানী। এখনও ফি বছর মুর্শিদাবাদ জেলায় কয়েক লক্ষ পর্যটক আসেন সিরাজের স্মৃতির খোঁজে। জানতে চান, আলিবর্দী-দৌহিত্রের শাসনকাল আর মর্মান্তিক পরিণতির কথা।
অথচ সেই পর্যটকদের অনেকেই মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যান। কারণ, পলাশির যুদ্ধের পর বাংলার মসনদে বসা বিশ্বাসঘাতক উত্তরসূরিদের অবহেলার কারণে সিরাজের অনেক স্মৃতিই উধাও হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। সেই তালিকাতেই রয়েছে হীরাঝিল। বস্তুত, ভাগীরথীর পূর্ব তীরে হাজারদুয়ারি প্রাসাদে রাখা তরোয়াল (যদিও সেটি সিরাজের ব্যবহার করা কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে), মদিনা থেকে মাটি এনে তৈরি করা মসজিদ এবং পশ্চিম তীরে সিরাজদ্দৌলার সমাধিক্ষেত্র খোশবাগ ছাড়া আর তেমন কিছুর অস্তিত্ব নেই আজ। হীরাঝিলের কয়েক কিলোমিটার দূরে সেই খোশবাগেও ধীরে ধীরে থাবা বসাচ্ছে ভাগীরথীর ভাঙন।
ভাগীরথীর গর্ভে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে হীরাঝিল।
ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে মুকুন্দবাগ অঞ্চলের বাগানপাড়া গ্রামে নবাব সিরাজের সাধের হীরাঝিল গত কয়েক দশক ধরে ছিল আগাছার জঙ্গল। তারই মধ্যে ইতিউতি নজরে আসত ধ্বংস হওয়া ইমারতের অস্তিত্ব। প্রাসাদের মূল অংশ কয়েকশো বছর আগেই ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু কেন নির্মাণের কয়েক বছর পরেই ধ্বংস হয় হীরাঝিল? জনশ্রুতি, মীরজাফর এবং তাঁর পরবর্তী নবাবদের ‘সৌজন্যেই’ এমনটা হয়েছিল। তাঁরা চাননি, সিরাজের সাধের প্রাসাদের অস্তিত্ব থাকুক। তাই রাতের অন্ধকারে প্রাসাদের নীচের মাটি ধীরে ধীরে কেটে ফেলে ভেঙে পড়ে যায়। পরে বিশাল চৌহদ্দির কিছুটা অংশ ভাগীরথীর গর্ভে চলে যায়।
হীরাঝিল যখন তৈরি হয় তখন সিরাজের দাদু নবাব আলীবর্দী বাংলার সিংহাসনে। আদরের নাতির ইচ্ছাপূরণ করতেই তিনি বানিয়েছিলেন এই প্রাসাদ। আর আর প্রাসাদটিকে সাজিয়েছিলেন নিজের মনের মতো করে। তিনটি গম্বুজ বিশিষ্ট এই প্রাসাদটিতে রংমহল, এনতাজমহল, দরবার মহল। পলাশির যুদ্ধে পরাজয়ের পরে মুর্শিদাবাদে ফিরে হীরাঝিল থেকেই নৌকায় রাজমহলের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন সিরাজ। কিন্তু ভগবানগোলায় মীরজাফরের বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান।
হীরাঝিলের ভাঙা ইটের খাঁজে জমে থাকা সিরাজের স্মৃতির খোঁজে এখনও প্রতি বছর আসেন বেশ কিছু পর্যটক। সমর্পিতা জানিয়েছেন, কয়েক বছর ধরেই স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ হীরাঝিল সংরক্ষণের দাবি জনমত গঠনের চেষ্টা শুরু করেছিলেন। গত বর্ষায় ভগ্নস্তূপের কিছুটা অংশ ভেঙে পড়ে। এর পর তৈরি করেন ‘হীরাঝিল বাঁচাও কমিটি’। শুরু হয়, সরকার এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে হীরাঝিল বাঁচানোর দাবিতে আবেদনের পালা। পাশাপাশি, শুরু হয় নিজেদের উদ্যোগে হীরাঝিল সংরক্ষণের প্রয়াসও। সাফ করা হয় হীরাঝিল ঘিরে থাকা আগাছার জঙ্গল। গত ৫ ডিসেম্বর অর্থাৎ রবিবার ‘হীরাঝিল বাঁচাও কমিটি’র সদস্যেরা লালবাগ সদরঘাট পশ্চিম পাড়ে জমায়েত করে হীরাঝিলে পৌঁছন। সেখানে সাংবাদিক বৈঠক করে হীরাঝিল সংরক্ষণের জন্য সরকারি পদক্ষেপের দাবি করা হয়। এর পরে হয় অঙ্কন এবং একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা। অঙ্কন প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল, ‘তোমার কল্পনায় হীরাঝিল’। প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার বিষয়, ‘হীরাঝিল প্রাসাদ সংরক্ষণ করা হলে মুর্শিদাবাদ কথা বাংলার পর্যটনে কতটা উন্নয়ন হবে’।
সমর্পিতা জানিয়েছেন, হীরাঝিল বাঁচাও কমিটির প্রথম পদক্ষেপ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী-সহ ১০ জন শীর্ষস্তরের আধিকারিকের দফতরে স্মারকলিপি পাঠিয়ে ভাগীরথীর ভাঙন থেকে সিরাজের প্রাসাদকে রক্ষার আবেদন জানানো। এই পদক্ষেপে সঙ্গী হয়েছেন বাংলাদেশে বসবাসকারী সিরাজ পরিবারের উত্তরসূরিরা। দুই দেশের নাগরিকদের যৌথ উদ্যোগে ‘অনলাইন পিটিশন’-এর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সমর্পিতা বলেন, ‘‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস রক্ষার স্বার্থে এবং পর্যটকদের কথা ভেবে হীরাঝিল প্রাসাদ সংলগ্ন ভাগীরথীর পাড় বাঁধাই করে সংরক্ষণ করা দরকার। সে ক্ষেত্রে আশপাশের গ্রামগুলিও নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা থেকে বাঁচবে।’’