West Bengal Panchayat Election 2023

ভোটের সাত দিন পার, ৫০ পার নির্বাচনী সন্ত্রাসের বলি, মৃতের সংখ্যায় শীর্ষে শাসক, দ্বিতীয় বিরোধীদল বিজেপি

পঞ্চায়েত ভোটের দামামা বাজার অনেক আগে থেকেই ‘অহিংসা’র বার্তা দিয়ে আসছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কিন্তু গোটা ভোট পর্বে সেটা যে সম্ভব হল না, মৃত্যুর পরিসংখ্যানেই তা স্পষ্ট।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৩ ২০:১১
Share:

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

পঞ্চায়েত ভোটের পর সাত দিন কেটে গিয়েছে। হয়ে গিয়েছে ভোটের ফলাফল ঘোষণাও। কিন্তু হিংসা, প্রাণহানি, রক্তপাত থামার নাম নেই রাজ্যে! মঙ্গলবার রাতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ে ভোটগণনাকে কেন্দ্র করে অশান্তিতে তিন জনের মৃত্যুর ঘটনা সাম্প্রতিক অতীতের সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে বলে দাবি অনেকের। সেই জেলাই আবার নতুন করে উত্তপ্ত হয়েছিল শুক্রবার রাতে। ক্যানিং এবং বিষ্ণুপুরেও খুন হন দুই তৃণমূল কর্মী। মৃত্যু হয়েছে ভোট-পর্বে জখম হওয়া আরও এক তৃণমূল এবং বিজেপি কর্মীর। এই চার মৃত্যু ধরে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে সন্ত্রাসের বলি ৫০ পেরিয়ে গিয়েছে!

Advertisement

পরিসংখ্যান বলছে, দলীয় নেতা-কর্মীদের মৃত্যুর সংখ্যার নিরিখে তালিকায় শীর্ষে রয়েছে শাসকদল তৃণমূল। ভোটপ্রক্রিয়ার সময়কালের মধ্যে শাসকদলের অন্তত ৩০ জন নেতা-কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার তৃণমূলের নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, তাঁদের দলের ৩১ জন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে ভোটপর্বে। তথ্য অনুযায়ী, তার পরেই নিহত হয়েছেন বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা। তাদের অন্তত সাত জন কর্মীর প্রাণ গিয়েছে। এ ছাড়াও বামেদের অন্তত পাঁচ, কংগ্রেসের চার এবং আইএসএফের তিন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে ওই সময়ের মধ্যে।

পঞ্চায়েত ভোটে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়েছে শাসক তৃণমূল। কিন্তু একইসঙ্গে তাদের ৩০ জন কর্মীর মৃত্যু আরও কিছু ‘বার্তা’ বহন করছে। শাসকদলের এত নেতা-কর্মীর মৃত্যুর নজির সাম্প্রতিককালে আছে বলে কেউ মনে করতে পারছেন না। বিশেষত, যখন বিরোধী বিজেপির নিহত কর্মীর সংখ্যা তার চেয়ে ২৩ কম— সাত জন। অনেকের মতে, তৃণমূলের অনেকের মৃত্যু হয়েছে গোষ্ঠীলড়াইয়ে। অর্থাৎ, তৃণমূলের লোকজনের হাতেই তৃণমূলের লোকজনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সেই তত্ত্বের বিরোধিতা করছে একটি অংশ। তাদের মতে, শাসক এবং বিরোধী শিবিরের মধ্যে মৃতের সংখ্যার এত ফারাক যে, তার কারণকে শুধ‌ুমাত্র গোষ্ঠীলড়াই বলে ব্যাখ্যা করা যায় না। আবার অনেকের মতে, তৃণমূলের লোকজন বিভিন্ন এলাকায় ‘সন্ত্রাস’ করতে গিয়ে ‘প্রতিরোধে’-এর মুখে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। অর্থাৎ, তাঁদের মৃত্যু হয়েছে ‘ক্রিয়া’র পাল্টা ‘প্রতিক্রিয়া’র কারণে। কারণ, যা-ই হোক, এত প্রাণহানির দায় শাসকদলের উপরেও বর্তায়। কারণ, সরকার তারাই পরিচালনা করে। যে কোনও দলেরই সদস্য বা সমর্থকের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তাদেরই।

Advertisement

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

গোটা ভোটপর্বে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন অবশ্য সরকারি ভাবে কিছু জানায়নি। তবে গত বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে (তখনও পর্যন্ত) রাজ্যে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা নিয়ে সে দিনই মুখ্যমন্ত্রীকে পাল্টা বিঁধেছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর দাবি ছিল, পঞ্চায়েত ভোটে তখনও পর্যন্ত ৫০ জনের কাছাকাছি মানুষ মারা গিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মৃত্যুর যে হিসাব দিয়েছেন, তা মানতে চায়নি সিপিএম এবং কংগ্রেসও।

তবে পরিসংখ্যান বলছে, পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্বের শুরুর দিন, অর্থাৎ ৯ জুন থেকে ১৪ জুলাই, শুক্রবার পর্যন্ত রাজ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মোট ৫২ জন নেতা-কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে মনোনয়ন পর্ব থেকে ভোটের আগের দিন অর্থাৎ, ৭ জুলাই পর্যন্ত সংঘর্ষে মারা গিয়েছেন ২৩ জন। ৮ জুলাই, ভোটের দিন সংঘর্ষে নিহত হন ১৫ জন (কমিশন জানিয়েছে, ১০ জন) এবং সেই দিন সংঘর্ষে জখম হয়ে পরে মৃত্যু হয় সাত জনের। গণনার দিন বা তার পরের সংঘর্ষে বা হামলায় মৃত্যু হয় আরও সাত জনের। এঁদের মধ্যে কারও কারও মৃত্যুর সঙ্গে আবার রাজনীতির যোগ রয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। তবে ভোটের সময় ঘটায় সেই সব ঘটনাতেও রাজনীতির রং লেগে গিয়েছে।

পঞ্চায়েত ভোটের দামামা বাজার অনেক আগে থেকেই ‘অহিংসা’র বার্তা দিয়ে আসছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। ভোট ঘোষণার আগে বিভিন্ন জনসভা, দলের ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচি থেকে বার বার ‘শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনের কথা বলতে শোনা গিয়েছিল অভিষেককে। তিনি জানিয়েছিলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ভোট করতে তাঁর দল কৃতসঙ্কল্প। কিন্তু গোটা ভোটপর্বে তা যে সম্ভব হল না, মৃত্যুর পরিসংখ্যানেই তা স্পষ্ট। বাংলায় পঞ্চায়েত ভোটে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ‘ঐতিহ্য’ দীর্ঘ কয়েক দশকের। সামগ্রিক প্রবণতা বলে, রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াইয়ে যখনই শাসকদল ও বিরোধীরা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, তখনই সংঘাত হয়েছে। গ্রামীণ রাজনীতির বৃত্তে যাঁরা ঘোরাফেরা করেন, তাঁদের মতে, পঞ্চায়েত দখল করলে অর্থ এবং দাপট দুয়েরই সুযোগ বাড়ে। এ কথাও অনস্বীকার্য যে, ক্ষমতার উত্থান-পতন মূলত নির্ধারিত হয় গ্রামের ভোটেই। কারণ, ভোটার সংখ্যায় গ্রামাঞ্চল অনেক এগিয়ে। তাই, পঞ্চায়েতকে ক্ষমতার প্রথম সোপান ধরে নিয়ে এখান থেকেই রাজনৈতিক সংঘাতের সূত্রপাত হয়। উঁচুতলার উত্তাপ বাড়তে থাকলে, নীচেও তার আঁচ বাড়ে। তীব্র হয় হিংসা, হানাহানি।

বামেরা ১৯৭৭-এ ক্ষমতায় বসলেও পঞ্চায়েত ভোটে বড় সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠা শুরু হয় মোটামুটি ১৯৮৮ অর্থাৎ বাম জমানার তৃতীয় বারের ভোট থেকে। একই ভাবে, বামেদের পতন ঘটিয়ে ২০১১-তে তৃণমূল সরকারে আসার পরে ২০১৩-র প্রথম পঞ্চায়েত ভোট খুব ঘটনাবহুল ছিল, তা নয়। অনেকের মতে, তার কারণ, মূল বিরোধী শক্তি বামেরা তখন একেবারেই ‘কোণঠাসা’। কিন্তু পরে রাজ্যে বিরোধী শক্তি হিসাবে বিজেপি মাথাচাড়া দেওয়ার পরে ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে উত্তেজনা শিখরে পৌঁছয়। এ বারের ভোটে শাসকদলকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে বিরোধীরা। যার ফলস্বরূপ, মনোনয়ন পর্ব থেকেই অশান্ত হয়ে ওঠে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়-ক্যানিং, মুর্শিদাবাদের রানিনগর-ডোমকল, কোচবিহারের দিনহাটা, উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া। এ ছাড়াও বিস্তর হিংসার ঘটনা ঘটেছে উত্তর ২৪ পরগনা এবং মালদহে। তবে সব ঘটনাতেই যে শাসক এবং বিরোধী শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে, তা নয়। অনেক জায়গায় শাসকদলের গোষ্ঠী কোন্দলের জেরেও অশান্তি ছড়িয়েছে। রক্তপাত, প্রাণহানি হয়েছে! যেমন, মনোনয়ন পর্বে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে অশান্ত হয়েছিল ক্যানিং। সংঘর্ষ, বোমাবাজিতে প্রাণও গিয়েছিল এক তৃণমূল কর্মীর।

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

পরিসংখ্যান বলছে, মৃত্যুর সংখ্যার নিরিখে শীর্ষে রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা। ঘটনাচক্রে, সেই জেলাতেই ডায়মন্ড হারবার সাংসদ অভিষেকের লোকসভা কেন্দ্র। মনোনয়নের দিন থেকে শুরু করে শুক্রবার পর্যন্ত এই জেলায় অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। মনোনয়নের শেষ দিনে, ১৫ জুন লাগামছাড়া সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছিল সেখানে। মনোনয়ন জমা দিতে না দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে তৃণমূল ও আইএসএফের সংঘর্ষে সেখানে তিন জনের মৃত্যু হয়। তাঁদের মধ্যে এক জন আইএসএফ কর্মী, নাম মহিউদ্দিন মোল্লা (২৪)। অন্য দু’জন তৃণমূলের কর্মী— রশিদ মোল্লা (৩৪) এবং রাজু সর্দার (৩২)। সেই থেকেই ভয়ে কুঁকড়ে থাকা ভাঙড়ে ভোটের দিনও বোমা পড়েছে, গুলি চলেছে। তবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু মঙ্গলবার ভোটগণনার রাতে আবার নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভাঙড়। তার অভিঘাতও দেখা গিয়েছে জেলার অন্য পঞ্চায়েত এলাকাগুলিতে। ভোটের ফল ঘোষণার পরেও সেখানে খুনখারাপি অব্যাহত।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো গোটা ভোটপর্ব জুড়ে অশান্ত ছিল মুর্শিদাবাদও। তথ্য বলছে, সেখানে অন্তত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রবণতা বলছে, বিরোধী গোষ্ঠী মাথা তুলে দাঁড়ালেই অশান্তি ছড়ায় এই জেলায়। এ বার কোমর বেঁধেই মাঠে নামতে দেখা গিয়েছিল বিরোধী শিবিরকে। ভোটের আগে জেলায় জোটের উত্থানও চোখে পড়ার মতো ছিল। পুরনো বাম ও কংগ্রেস কর্মীদের পাশাপাশি শাসক দলের ‘বিক্ষুব্ধ’ অংশকে ভিড়তে দেখা গিয়েছিল বিরোধী শিবিরে। শাসক-বিরোধী দু’পক্ষেরই পাল্লা ভারী হওয়ায় নানা সময়ে সংঘর্ষে জড়িয়েছে তারা। তার ফলস্বরূপ, অন্তত ছ’জনের প্রাণ গিয়েছে শুধু ভোটের দিনের সংঘর্ষেই। মনোনয়ন শুরুর দিনেই মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামে কংগ্রেস কর্মী ফুলচাঁদ শেখের মৃত্যু ঘিরে রাজনৈতিক চাপানউতর তৈরি হয়েছিল। তবে সেটি রাজনৈতিক কারণেই খুন কি না, বিতর্ক ছিল তা নিয়ে। পরে মুর্শিদাবাদ সফরে গিয়ে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও ফুলচাঁদের বাড়িতে যান। ঘটনাচক্রে, ফুলচাঁদ খুনে যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, সেই তৃণমূল নেতা সাবিরউদ্দিন শেখকে কুপিয়ে খুন করা হয় ভোটের দিন। ওই দিনই জেলার রেজিনগরে খুন হন ইয়াসিন শেখ নামে আর এক তৃণমূল কর্মী। সিপিএম সমর্থককে লালগোলায় পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে। নওদাতেও খুন করা হয় এক কংগ্রেস কর্মী।

এ বার ভোট-সন্ত্রাসের সাক্ষী থেকেছে কোচবিহার জেলার দিনহাটা, গিতালদহ, শীতলখুচি-সহ বেশ কয়েকটি জায়গা। লাগাতার সংঘর্ষে জড়িয়েছে শাসকদল এবং বিজেপি। ভোটপর্বে সেই সংঘর্ষেই জেলায় মারা গিয়েছেন অন্তত ছ’জন। মালদহেও পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে ভোটের সময়। তিন জন করে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর গ্রাণ গিয়েছে উত্তর দিনাজপুর, পূর্ব বর্ধমান এবং নদিয়ায়। উত্তর ২৪ পরগনা এবং পুরুলিয়াতেও দু’জন করে রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। বীরভূমে রাজনৈতিক সংঘর্ষে প্রাণ গিয়েছে এক জনের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement