১০০ দিনের কাজ

মজুরি প্রাপকের তালিকায় মৃতেরাও

কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১০০ দিনের কাজের মজুরি সরাসরি শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়বে। এতে আপত্তি তুলেছে নবান্ন। কিন্তু রাজ্যে প্রকল্পটি কেমন চলছে? মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, প্রকল্প রূপায়ণে রাজ্যে শীর্ষে জঙ্গলমহল। সেই জঙ্গলমহলেরই এক পঞ্চায়েত পুরস্কারও পেয়েছে। সেই পঞ্চায়েতে প্রকল্পটির বাস্তব অবস্থা সরেজমিনে দেখল আনন্দবাজার। কেউ মারা গিয়েছেন চার বছর আগে। কেউ সাত বছর। কেউ আরও বেশি। অথচ, ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের ওয়েবসাইট বলছে, তাঁরা সকলেই জীবিত! ওই প্রকল্পে ‘মাটি কাটার কাজ’ করে মজুরিও পেয়েছেন!

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৫
Share:

বাঁদিক থেকে সুশীলা শৃগাল (ম়ৃত্যু ২০১২), সতীশচন্দ্র বাগ (ম়ৃত্যু ২০০৯), সৃষ্টিধর রানা (ম়ৃত্যু ২০০১)।(ওয়েবসাইটে দেওয়া পঞ্চায়েতের তথ্য বলছে, এঁরা জীবিত। ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ করে টাকাও পেয়েছেন।)

কেউ মারা গিয়েছেন চার বছর আগে। কেউ সাত বছর। কেউ আরও বেশি।

Advertisement

অথচ, ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের ওয়েবসাইট বলছে, তাঁরা সকলেই জীবিত! ওই প্রকল্পে ‘মাটি কাটার কাজ’ করে মজুরিও পেয়েছেন!

এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের মজুরি দেওয়া নিয়ে কেন্দ্রের নয়া সিদ্ধান্তে যখন আপত্তি তুলছে রাজ্য সরকার, তখন এখানকার জঙ্গলমহলের এক পঞ্চায়েতে মৃতকে ‘জীবিত’ দেখিয়ে ওই প্রকল্পে কাজ দেওয়া এবং টাকা তুলে নেওয়ার মতো দুর্নীতির অভিযোগ সামনে চলে এসেছে। পঞ্চায়েতটি পশ্চিম মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুর-১ ব্লকের তৃণমূল পরিচালিত সারিয়া। যে পঞ্চায়েত ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে একশো দিনের প্রকল্প রূপায়ণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকার জন্য জেলা প্রশাসনের পুরস্কার পেয়েছে, সেই পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠায় অস্বস্তিতে প্রশাসন এবং শাসক দলও।

Advertisement

প্রকল্পটি রূপায়ণের দায়িত্ব পঞ্চায়েতেরই। অভিযোগ, ভুয়ো মাস্টার-রোলে দু’টি অর্থবর্ষে মৃতদের ‘জীবিত’ দেখিয়ে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছে সারিয়া পঞ্চায়েত। বাস্তবে সেই সব প্রকল্পের কোনও কাজই হয়নি। অসঙ্গতি মূলত ওই পঞ্চায়েতের ধর্মপুর ৫৮ এবং ৫৯ নম্বর সংসদ এলাকাকে ঘিরে। মৃতদের আত্মীয় এবং গ্রামবাসীদের একাংশ ওয়েবসাইট থেকে ওই অসঙ্গতির কথা জানতে পেরে গত ২৬ সেপ্টেম্বর গোপীবল্লভপুর-১ ব্লকের বিডিও-র কাছে অভিযোগ জানান। কয়েক দিন আগে মহকুমাশাসকের কাছেও অভিযোগ জানানো হয়।

কেমন সে অসঙ্গতি?

বছর চারেক আগে মারা যান ধর্মপুরের বৃদ্ধা সুশীলা শৃগাল। অথচ, ১০০ দিনের প্রকল্পের ওয়েবসাইট বলছে, ২০১৫-১৬ বর্ষে ৫৫ দিন এবং ২০১৬-১৭ বর্ষে ১২ দিন কাজ করে মজুরি পেয়েছেন তিনি! সতীশচন্দ্র বাগ মারা যান ২০০৯ সালে। ওয়েবসাইট বলছে, ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে সতীশবাবু ১৭ দিন কাজ করেছেন! ২০০১ সালে মারা যান সৃষ্টিধর রানা। কিন্তু ওয়েবসাইট বলছে, ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে ৩৫ দিন এবং ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে ২৭ দিন কাজ করেছেন সৃষ্টিধরবাবু!

গত বছর প্রায় ৬ দিন কাজ পেয়েছি। প্রশাসনিক নথিতে নাকি আমার পরিবার ১০২ দিন কাজ পেয়েছে লেখা আছে! জব-কার্ডে তা নেই।

কয়েকজন মৃতের নামে ওই প্রকল্পের টাকা তোলা হয়েছে বলে কিছু বাসিন্দা মৌখিক অভিযোগ করেছিলেন। কেউ লিখিত অভিযোগপত্র দেননি।

এমন উদাহরণ আরও রয়েছে। গ্রামবাসীদের আরও অভিযোগ, মাস্টার-রোলে যে সব জীবিত ব্যক্তির নাম রয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১৩৫ জনের জব কার্ডে কোনও ‘এন্ট্রি’ নেই। অথচ, তাঁরা কেউ ৭০ দিন, কেউ ১০০ দিন পর্যন্ত কাজ করেছেন বলে দেখানো হয়েছে। ধর্মপুরের বাসিন্দা চম্পাবতী সাউ বলেন, “গত বছর প্রায় ৬ দিন ওই প্রকল্পে কাজ পেয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসনের নথিতে নাকি আমার পরিবার ১০২ দিন কাজ পেয়েছে বলে লেখা হয়েছে! অথচ, সে কথা জব-কার্ডে নেই।”

বর্তমানে ওই প্রকল্পে পঞ্চায়েতের সুপারভাইজাররা শ্রমিকদের নাম মাস্টার-রোলে তোলেন। তার পরে শ্রমিকদের নাম-ঠিকানা, কাজের বিবরণ পঞ্চায়েত থেকে ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়া হয়। কেন্দ্রের থেকে টাকা আসে রাজ্যের কাছে। রাজ্য পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সেই টাকা শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বা ডাকঘর অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয়। ধর্মপুরের শ্রমিকদের একশো দিনের মজুরি মেটানো হয় আশুই শাখা ডাকঘরে তাঁদের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। কিন্তু কী ভাবে ঘটল এমন অসঙ্গতি?

সরাসরি মুখ খুলতে চাননি পঞ্চায়েত প্রধান বাবলু মুর্মু। তিনি বলেন, “কয়েকজন মৃতের নামে ওই প্রকল্পের টাকা তোলা হয়েছে বলে কিছু বাসিন্দা মৌখিক অভিযোগ করেছিলেন। কেউ লিখিত অভিযোগপত্র দেননি।” ওই ডাকঘরের পোস্টমাস্টার দিলীপ রানা পঞ্চায়েত সদস্যা অর্চনা পালের আত্মীয়। দিলীপবাবু অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মৃতেরা কী ভাবে টাকা পেলেন, তা নিয়ে কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি।
তবে, ঝাড়গ্রামের মহকুমাশাসক নকুলচন্দ্র মাহাতো জানিয়েছেন, অভিযোগ খতিয়ে দেখে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হবে। বিডিও বিশ্বনাথ চৌধুরী জানান, মৃতদের নামের জব-কার্ড জমা দিতে বলা হয়েছে পঞ্চায়েতকে। ডাক কর্তৃপক্ষের কাছেও চিঠি দিয়ে এ নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement