শেষ শ্রদ্ধা: উত্তরাখণ্ডে দুর্ঘটনায় মৃত ভুঁইয়া পরিবারের তিন জনের কফিনবন্দি দেহ এসে পৌঁছল বাড়িতে। শুক্রবার, পাটুলিতে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
বেড়িয়ে তাঁরা সকলেই ফিরলেন। তবে, কফিনবন্দি হয়ে।
শুক্রবার ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ছ’টা। গড়িয়ার শ্রীনগরে এসে পৌঁছল পরপর তিনটি শববাহী গাড়ি। বুধবার রাত থেকে যে উৎকণ্ঠা গ্রাস করেছিল গোটা পাড়াকে, এক লহমায় তার বাঁধ ভাঙল। তিনটি কফিন রাখতেই তার উপরে আছড়ে পড়লেন এক বৃদ্ধা। হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে চললেন, ‘‘আমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর। তোরা কথা দিচ্ছিস, নিয়ে যাবি।’’ বৃদ্ধাকে সামলানো প্রতিবেশীদের চোখেও জল। তাঁদেরই এক জন বললেন, ‘‘উনি ঝুমুর ভুঁইয়ার মা জ্যোৎস্না দাস মহাপাত্র।’’
দিনকয়েক আগেই ওই বাড়ির কর্তা মদনমোহন ভুঁইয়া স্ত্রী ঝুমুর এবং ছেলে নীলেশকে নিয়ে উত্তরাখণ্ডের টিহরী গাড়োয়ালে ট্রেকিং করতে যাওয়ার সময়ে পড়শি ও ভাড়াটেদের বলে গিয়েছিলেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ফিরে আসবেন। কিন্তু তাঁরা যে এ ভাবে ফিরবেন, সে কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি আত্মীয়েরা।
কী ভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে চলেছে নানা আলোচনা। মদনমোহনবাবুর ভাইপো নীলাদ্রিশেখর যোগাযোগ রাখছিলেন উত্তরাখণ্ড প্রশাসনের সঙ্গে। দাদা-বৌদি ও ভাইপোর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বুধবার রাতেই রওনা হয়েছিলেন মদনমোহনবাবুর ভাই মানস। সমস্ত প্রশাসনিক প্রক্রিয়া মিটিয়ে এ দিন সকালে তিনটি মৃতদেহ পৌঁছয় দিল্লি বিমানবন্দরে। সেখান থেকে দুপুরে দেহ নিয়ে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেন মানসবাবু। সাড়ে তিনটে নাগাদ কলকাতার মাটি ছোঁয় বিমান।
প্রথমে ঠিক ছিল, বিমানবন্দর থেকে মৃতদেহ আসবে শ্রীনগরে। সেখান থেকে তা নিয়ে যাওয়া হবে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমায় তাঁদের আদি বাড়িতে। কিন্তু মদনমোহনবাবুর স্ত্রী ঝুমুরের কর্মস্থল, নিউ ব্যারাকপুরের এপিসি কলেজের সহকর্মীরা অনুরোধ করেছিলেন, কিছু ক্ষণের জন্য হলেও যেন কলেজে ঝুমুরের মরদেহ নিয়ে আসা হয়। সেই মতো বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ কফিনবন্দি তিনটি দেহ প্রথমে পৌঁছয় এপিসি কলেজে। সেখানে শেষ শ্রদ্ধা জানান কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীরা।
বুধবার রাতেই মদনমোহনবাবুর মা অণিমাদেবী জেনে গিয়েছিলেন বড় ছেলে, বৌমা আর নাতির মৃত্যুসংবাদ। এ দিন মদনমোহনবাবুর মেজো ভাই মনোজ ভুঁইয়া বলেন, ‘‘বুধবার রাতেই ছোট ভাই মানস আমাকে ফোন করে এই দুঃসংবাদ দেয়। আমি বাড়ির বাইরে ছিলাম। ফোন ধরেছিল মা। তখনই উনি সব জেনে গিয়েছেন। মাকে এখন কী ভাবে সামলাব?’’ মনোজবাবু জানান, তাঁর মায়ের ইচ্ছানুসারে পাথরপ্রতিমার লক্ষ্মীপুরে বাড়ির কাছেই হবে শেষকৃত্য।
দুর্ঘটনার পর থেকেই ভুঁইয়া পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর পিন্টু দেবনাথ। তিনি বলেন, ‘‘মদনমোহনবাবুদের ঘরের চাবি ওঁদের কাছেই ছিল। এখন পদ্ধতি অনুযায়ী ঘর খুলতে হবে। থানাকে বিষয়টি জানিয়ে রাখা হয়েছে।’’ রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার চেয়ারম্যান পারিষদ নজরুল আলি মণ্ডল বলেন, ‘‘পুলিশ ও প্রশাসনের সহায়তায় মৃতদেহ পাথরপ্রতিমায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা ভুঁইয়া পরিবারের পাশে রয়েছি।’’
এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন মদনমোহনবাবুদের সহযাত্রী, ব্যারাকপুরের দেবমাল্য দেবনাথ আর নৈহাটির প্রদীপ দাস। এ দিন শেষ বিকেলে দু’জনের দেহ বাড়িতে আসার পরে সেখানে ভেঙে পড়ে গোটা পাড়া। নৈহাটিতে প্রদীপবাবুর দেহ পৌঁছনোর আগেই সেখানে চলে গিয়েছিলেন স্থানীয় পুরপ্রধান অশোক চট্টোপাধ্যায়। কিছু ক্ষণ বাড়িতে দেহ রাখার পরে নিয়ে যাওয়া হয় গঙ্গার ধারে রাম ঘাটে। সেখানেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় প্রদীপবাবুর।
দেবমাল্যবাবুর দেহ প্রথমে তাঁর কর্মস্থল কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আনা হয় ব্যারাকপুরে শ্যামশ্রীপল্লির বাড়িতে। ‘‘ফি বছর দুর্গাপুজোয় দেবমাল্য উদ্যোগী হত। একটা প্রাণোচ্ছল ছেলে কেমন এক ঝটকায় হারিয়ে গেল!’’ বলতে বলতে চোখ ভিজে আসছিল দেবমাল্যবাবুর ছোটবেলার বন্ধু সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। বাড়ির সামনে তখন শ্মশানের স্তব্ধতা।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।