নিরুপায় হয়েই ভিটেমাটি ছাড়তে শুরু করেছেন ঘোড়ামারার বহু বাসিন্দা। —নিজস্ব চিত্র।
দিন কয়েকের মধ্যেই চেনা দ্বীপটা যেন ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। ভিটেমাটি, জমিজিরেত, গোলাভরা ধান— সবই ভেসে গিয়েছে নোনাজলে। ইয়াস আসার পর ৫ দিন কেটে গেলেও ঘোড়ামারা দ্বীপের বহু জায়গায় এখনও শুধু জল আর জল। ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্ক সত্ত্বেও অনেকেই ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়েছিলেন। তবে জল না নামায় থাকা খাওয়ার চিন্তায় ঘুম উড়েছে তমিনা বিবি, সনাতন জানাদের মতো দ্বীপের বহু বাসিন্দার। অগত্যা নিরুপায় হয়েই একে একে ভিটেমাটি ছাড়তে শুরু করেছেন তাঁরা।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগর ব্লকের ঘোড়ামারা দ্বীপের ৩ দিক ঘিরে বটতলা, হুগলি এবং মুড়িগঙ্গা নদী। অন্য দিকে বঙ্গোপসাগর। প্রতিদিনই নদী আর সমুদ্র যেন দ্বীপটিকে গিলে খাচ্ছে। ২০১০ সাল থেকেই ভাঙনের গ্রাসে তলিয়ে গিয়েছে লক্ষ্মীনারায়ণপুর, বাগপাড়া, বৈষ্ণবপাড়া এবং খাসিমারার একাংশ। ফলে বাঁধভাঙার আতঙ্ক কখনই পিছু ছাড়েনি দ্বীপের বাসিন্দাদের। দ্বীপের প্রায় ৫ হাজার ৮০০ জনের মধ্যে ভোটার ৩ হাজার। আয়লা, বুলবুল, আমপানের মতো ঘূর্ণিঝড়ের পর সম্প্রতি ইয়াস এবং পূর্ণিমার কটালের জলোচ্ছ্বাসের জেরে প্লাবিত হয় গোটা দ্বীপটাই। তবে এখন জলে ডুবে আছে মন্দিরতলা, খাসিমারা, হাটখোলা, চুনপুরি, বাগপাড়া-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা।
মঙ্গলবার দুপুরে ঘোড়ামারা দ্বীপের মন্দিরতলা ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল ২টি নৌকা। প্রায় জনা পঞ্চাশেক বাসিন্দাকে নিয়ে রওনা দিল ভুটভুটি। গন্তব্য সাগর। বাসভূমি ছেড়ে তাতে করেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে রওনা দিয়েছেন তমিনা-সনাতনরা।
ঘোড়ামারার চুনপুরির বাসিন্দা তমিনা বিবির বিয়ে হয়েছিল বছর দুয়েক আগে। স্বামী পাড়ি দিয়েছিলেন ভিন্ রাজ্যে। এখনও বাড়ি ফেরেননি। সংসার ফেলে শ্বশুর-শাশুড়ি, কন্যাসন্তানকে নিয়ে তমিনা যাচ্ছেন সাগরে। চোখের সামনে ঘর ডুবে যেতে দেখেছেন। ভেসে গিয়েছে আসবাবপত্র, গহনা-সহ প্রয়োজনীয় নথিপত্র। কার্যত সর্বহারা তমিনার কথায়, ‘‘বুঝিনি, নদীর জল এসে ভিটেমাটি কেড়ে আমাদের নিঃস্ব করে দেবে। এখনও উঠোনে জল জমে রয়েছে। সাগরে আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছি। জানি না, কবে ফিরতে পারব।’’
ঘোড়ামারা দ্বীপের বহু বাসিন্দাকে ঘিরে ধরেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা। —নিজস্ব চিত্র।
তমিনার মতোই ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বছর পঁচিশের সনাতন জানা। দ্বীপেরই একটি স্কুলে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। পরে বাবার সঙ্গে পুরোদমে চাষের কাজে নেমে পড়েছিলেন। ঘোড়ামারার কয়েক বিঘা জমিতে পানের বরজ রয়েছে তাঁর। গত বারের চাষে প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল। লাভের আশায় এ বার বেশ অনেকটা জমিতেই পানের বরজ তৈরি করেছিলেন। ভেবেছিলেন, যা পান উঠবে তা বিক্রি করেই বাজারের পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দেবেন। কিন্তু ইয়াস তা-ও কে়ড়ে নিল। ছল ছল চোখে বললেন, ‘‘এমনিতেই ভাঙন দ্বীপটাকে গিলে চলেছে। তার উপর জল বাড়ায় বাড়ি ঘর, পান, বরজ— সব শেষ হয়ে গেল।’’