ফাইল চিত্র
সুন্দরবনের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয়েছে একটি উচ্চচাপ এলাকা। আর তাতেই অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ইয়াসকে সম্ভবত ফাঁকি দিতে চলেছে দুই ২৪ পরগনা এবং সুন্দরবন। অন্তত বঙ্গোপসাগরের ওই এলাকায় মঙ্গলবার সকালের বাতাসের গতিপ্রকৃতি দেখে এমনই মনে হচ্ছে আবহাওয়াবিদদের। তাঁরা মনে করছেন, ওই উচ্চচাপ বলয় ওড়িশা-পূর্ব মেদিনীপুরেই আটকে রাখবে ইয়াসকে। তাই দুই ২৪ পরগনা ও সুন্দরবনের বদলে ভোগান্তি হবে ওড়িশার বালেশ্বর এবং পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের।
আসলে ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে কোনও ঘূর্ণিঝড় তৈরি হলে তা ঠিক কোথা দিয়ে স্থলভূমিতে ঢুকবে— ওড়িশা, ভারতীয় সুন্দরবন না কি তা পেরিয়ে কোথাও আছড়ে পড়বে, তা নির্ভর করে সুন্দরবনের দক্ষিণে সমুদ্রের বায়ুপ্রবাহের উপরে। অতীতে দেখা গিয়েছে ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে কোনও ঘূর্ণিঝড় তৈরি হলে তার বেশির ভাগই চলে গিয়েছে মায়ানমারের দিকে। কখনও বা আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে। ২০০৮ সালের সিডারে যেমন বিধ্বস্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। ২০০৯ সালের আয়লাও দক্ষিণ ২৪ পরগনার উপকূল ছুঁয়েই চলে গিয়েছিল বাংলাদেশে। গত বছর আমাপানের ক্ষেত্রেও যদি বঙ্গোপসাগরে মায়ানমার উপকূলের দিকে কোনও উচ্চচাপ বলয় তৈরি হত, তা হলে সাগরদ্বীপ, কাকদ্বীপ, নামখানা আর সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য এতটা বিপর্যস্ত হত না। এ বার ওই জায়গায় উচ্চচাপ বলয়টি আছে। তাই কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পারেন দুই ২৪ পরগনা জেলার মানুষ।
কী ভাবে উচ্চচাপ বলয় ঘূর্ণিঝড়ের গন্তব্য ঠিক করে দেয়?
ফাইল চিত্র
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশ উপকূল দু’ভাবে ঘূর্ণিঝড়গুলির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে। ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্রে কোনও নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হলে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা তার সম্ভাব্য গতিপথ নির্ণয়ে দিনরাত এক করে দেন। সেই পূর্বাভাসের উপরেই প্রস্তুতির বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে। আর তখনই সুন্দরবনের দক্ষিণে সমুদ্রে বায়ুপ্রবাহের গতিপ্রকৃতি কেমন সে দিকে মনোনিবেশ করা হয়। আবহাওয়াবিদদের মতে, মায়ানমার উপকূলের দিকে কোনও নিম্নচাপ বলয় তৈরি হলে ঘূর্ণিঝড়কে সেটি তার দিকে নিয়ে যায়। অর্থাৎ ওই ঘূর্ণিঝড় ওই নিম্নচাপ এলাকার দিকে ধেয়ে যায়। কিন্তু সেখানে উচ্চচাপ বলয় থাকলে সে দিকে আর ঘূর্ণিঝড় এগোতে পারে না। সে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ঘন ঘন গতি পরিবর্তন করতে থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি বাড়তে থাকে। তার সঠিক গতিপথ চিহ্নিত করতে বেগ পেতে হয় আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের। তাঁরা একটা বিশাল এলাকাকে সম্ভাব্য অঞ্চল বলে চিহ্নিত করেন। ঘূর্ণিঝড় অনেকটা শক্তি বাড়িয়ে উপকূলের কাছাকাছি এলে তবে বোঝা যায় কোথায় আঘাত হানতে পারে বিশাল শক্তিশালী বায়ুদানব।
কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিজ্ঞান মন্ত্রকের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গোকুলচন্দ্র দেবনাথ সিডার এবং আয়লার সময় আলিপুর হাওয়া অফিসের অধিকর্তা ছিলেন। গোকুলচন্দ্র বলেন, ‘‘ওই দু’টি ক্ষেত্রেই মায়ানমার উপকূলের কাছে নিম্নচাপ বলয় তৈরি হয়েছিল। ফলে ওই দুটি ঘূর্ণিঝড় সোজা পথে এসে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত করেছিল। আয়লা পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন এলাকা ছুঁয়ে চলে গিয়েছিল। আর আমপানের ক্ষেত্রে মায়ানমার উপকূলের কাছে উচ্চচাপ বলয় থাকায় অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়টি কোথায় আঘাত করতে পারে তা প্রথম থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। যদি ওই উচ্চচাপ বলয় আরও বিস্তৃত হত, তবে গত বছরও ঝড়ের সম্ভাব্য গন্তব্য হত ওড়িশা এবং পূর্ব মেদিনীপুর উপকূল।
ফাইল চিত্র
প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালে ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার বেগের যে সুপার সাইক্লোন ওড়িশার কেন্দ্রাপাড়া উপকূলের বিশাল এলাকাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল, সেটিও পশ্চিমবঙ্গের দিকে এগিয়ে আসতে পারত। কিন্তু মায়ানমারের সমুদ্রে শক্তিশালী উচ্চচাপ বলয় ওই ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়কে ওড়িশাতেই আটকে রেখেছিল। ঘূর্ণিঝড়ের আশপাশে যত জলীয় বাষ্প জমতে থাকে ততই সে ভারী হতে থাকে। এই সময় তার অবস্থা হয় অতিরিক্ত ভারবাহী যানের মতো। সে পড়িমড়ি করে গন্তব্যের দিকে ছুটতে থাকে। মাল খালাস করতে। আর সেই সময়েই পরিষ্কার হয়ে যায় তা কোথায় আছড়ে পড়বে। ইয়াস কিন্তু একটা বড় প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের কাছে। আরব সাগরের অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় টাউটে-র ঠিক পরে পরেই বঙ্গোপসাগরে ইয়াস কী ভাবে এত তাড়াতাড়ি তৈরি হতে পারল? এক অভিজ্ঞ আবহাওয়াবিদ বলছেন, ‘‘সাধারণত দেখা যায় আরব সাগরে কোনও গভীর নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় তৈরি হলে তা বঙ্গোপসাগরের উপর থেকে সব জলীয় বাষ্প টেনে নিয়ে যায়। ফলে বঙ্গোপসাগর উপকূলের এলাকাগুলিতে নিম্নচাপ তৈরির প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। আরব সাগরের ঘূর্ণিঝড় টাউটে স্থলভুমিতে ঢুকে পুরোপুরি শক্তি হারানোর আগেই আন্দামান সাগরে তৈরি হয়েছে নিম্নচাপ এলাকা। সেটাই ফুলেফেঁপে জন্ম নিয়েছে ইয়াস।’’
সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে উপরের বায়ুস্তরও গরম হয়ে উপরের দিকে উঠে যায়। ফলে সমুদ্রের ওই অঞ্চলে নিম্নচাপ বলয় তৈরি হয়। আশপাশের বায়ুপ্রবাহের গতিপ্রকৃতি ঠিক করে দেয় ওই নিম্নচাপের ভবিষ্যৎ। আরব সাগরে এমনই একটি নিম্নচাপ বলয় সমুদ্রের মধ্যে পাক খেতে রূপান্তরিত হয়েছিল টাউটেতে। আর গত সপ্তাহের মাঝামাঝি আন্দামান সাগরে তৈরি হওয়া নিম্নচাপ বলয় ধ্বংসের বার্তা নিয়ে এগোচ্ছে স্থলভূমির দিকে। টাউটে আর ইয়াসের যুগলবন্দি এ বারের বর্ষাকে কতটা প্রভাবিত করবে, এ বার সেটাই দেখতে চাইছে আবহাওয়া মন্ত্রক।’’