তা হলে কি শেষ পর্যন্ত বঙ্গেই হানা দেবে জ়ওয়াদ?
গতি বদলাক বা মতি, ‘জ়ওয়াদ’ বা উদার ঘূর্ণিঝড় এ-যাত্রা বাংলার প্রতি খানিকটা উদারতা দেখাতে চলেছে বলেই আশ্বাস দিচ্ছে দিল্লির মৌসম ভবন। শুক্রবার রাতের উপগ্রহ-চিত্র বিশ্লেষণ করে তারা জানিয়েছে, ওড়িশা থেকে বঙ্গের উপকূলের দিকে আসার পথেই শক্তি খোয়াতে শুরু করবে ওই ঝড়। এবং সোমবার বাংলা উপকূলে আসতে আসতে শক্তি খুইয়ে আবার গভীর নিম্নচাপে পরিণত হবে সে। আবহবিদদের আশ্বাস, সে-ক্ষেত্রে ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা কম। তবে বর্ষণের মাত্রা অনুযায়ী অঞ্চলভেদে ক্ষয়ক্ষতি, বিশেষত ধান-সহ নানান শস্য নষ্টের কমবেশি আশঙ্কা থাকছেই।
নৈশ বার্তায় আশ্বাসের আগে হাওয়া অফিস জানিয়েছিল, সোজা পথের বদলে এ বারের ঘূর্ণিঝড়ের গতি হতে পারে সর্পিল! তখন মৌসম ভবনের পূর্বাভাস ছিল, মধ্য বঙ্গোপসাগর থেকে সোজা ওড়িশা-অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলে ধেয়ে আসবে জ়ওয়াদ। স্থলভূমিতে না-ঢুকে এক দফা বাঁক নিয়ে পুরীর কাছে হাজির হবে। কিন্তু নীলাচল দর্শন না-করে, আরও এক দফা বাঁক নিয়ে মুখ ফেরাবে বঙ্গের দিকে! তখনও পর্যন্ত ঝড়ের মেজাজমর্জির যেটুকু আঁচ মিলেছিল, তাতে বাংলায় আশঙ্কা জাগে, তা হলে কি শেষ পর্যন্ত বঙ্গেই হানা দেবে জ়ওয়াদ? কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (পূর্বাঞ্চল) সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “মনে হচ্ছে, পুরী পর্যন্ত এসে জ়ওয়াদ বাংলার দিকে মুখ ফেরাতে পারে।
কিন্তু কতটা শক্তি নিয়ে সে পশ্চিমবঙ্গে আসবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।” অনেকাংশে সেই অনিশ্চয়তার নিরসন ঘটিয়ে রাতে মৌসম ভবন যে-বার্তা দিয়েছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গ অনেকটাই আশ্বস্ত হতে পারে বলে জানাচ্ছে আবহবিদ শিবির।
তবে অনিশ্চয়তার জন্য কলকাতা বিমানবন্দর চালু রাখা বা বন্ধ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ফণী, ইয়াস, আমপানের সময় কলকাতা বিমানবন্দর বন্ধ ছিল। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানান, এ বার যা হওয়ার, রবিবার বিকেলের পরে হবে। তখন হাওয়ার গতিবেগ ঘণ্টায় ৪৫ কিলোমিটারের বেশি থাকলে বন্ধ হবে বিমান ওঠানামা। দূরপাল্লার প্রচুর ট্রেন অবশ্য ইতিমধ্যেই বাতিল করা হয়েছে। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে মাঝ-আকাশে দুর্যোগ টের পেয়ে পাইলটেরা রুট ছেড়ে ঘুরপথ ধরেন। এ দিনেও দুর্যোগপূর্ণ মেঘ এড়ানোর জন্য ঘুরপথ নেয় পোর্ট ব্লেয়ারের বিমান।
ঝড়ের দাপট থেকে রেহাইয়ের আশ্বাস মিললেও প্রশাসনিক প্রস্তুতি চলছে সব দিক থেকে। বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস জানান, শনিবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত বিদ্যুৎ ভবনে কন্ট্রোল রুম চালু থাকবে। কন্ট্রোল রুম থাকবে জেলার আঞ্চলিক কার্যালয়েও। সব ব্লক ও জেলার আধিকারিকদের সঙ্গে সমন্বয় রাখবে বিদ্যুৎ দফতর। ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎকর্মীদের ছুটি বাতিল। জেলায় কর্মীদের ভ্রাম্যমাণ দল তৈরি থাকবে। কলকাতার ১ থেকে ৮৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভূগর্ভে কেব্ল থাকায় সেখানে থানা-ভিত্তিক একই ধরনের দল মোতায়েন রাখা হবে। থানা-ভিত্তিক দল থাকবে সিইএসসি এলাকাতেও। বিদ্যুৎ ভবনের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগের নম্বর: ৮৯০০৭৯৩৫০৩ এবং ৮৯০০৭৯৩৫০৪। সিইএসসি-র কন্ট্রোল রুম নম্বর: ৯৮৩১০৭৯৬৬৬ এবং ৯৮৩১০৮৩৭০০।
জ়ওয়াদ আঁকাবাঁকা পথ ধরতে চায় কেন? সঞ্জীববাবুর ব্যাখ্যা, আবহমণ্ডলের উপরের স্তরের বায়ুপ্রবাহের অভিমুখ ঘূর্ণিঝড়ের অভিমুখ নির্ধারণ করে। তার ফলেই ঘূর্ণিঝড়ের অভিমুখ বদলায়। উপকূলের খুব কাছে এসে এই ঘূর্ণিঝড়ের বাঁক নেওয়ার প্রবণতা অদ্ভুত মনে হতে পারে। তবে আবহবিজ্ঞানে এটা অস্বাভাবিক বা বিরল নয়। আবহবিদদের অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে ‘মাদি’ নামে একটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল। সে উপকূলের কাছে এসে বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরের ধাক্কায় সমুদ্রে ফিরে বিলীন হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলও এমন বাঁক নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ছুঁয়ে বয়ে গিয়েছিল ওড়িশার দিকে। ২০১৯ সালে পথ বদল করেছিল ফণীও।
অনেক আবহবিদের বক্তব্য, শীতের এই সময়ে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাতাস বয়। যার অর্থ, ঘূর্ণিঝড়ের অভিমুখের বিপরীত দিক থেকে বাতাস বইছে। সে-ই ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে ঝড়কে। জ়ওয়াদ খুব শক্তিশালী ঝড় নয়। তাই বিপরীতমুখী বায়ু ঠেলে নিজের অভিমুখ বজায় রাখা তার পক্ষে কঠিন হতে পারে। শুষ্ক উত্তুরে হাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে ঢুকে পড়লে নিস্তেজ হয়ে যেতে পারে জ়ওয়াদ। শেষ পর্যন্ত সে-রকম কিছু ঘটতে চলেছে কি না, আজ, শনিবার তা জানাতে পারে হাওয়া অফিস।
বিকেলে আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছিল, শনিবার দুই মেদিনীপুরের দু’-একটি জায়গা, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, ঝাড়গ্রাম, হাওড়া ও হুগলির দু’-একটি জায়গায় ভারী বৃষ্টির সঙ্গে ঘণ্টায় ৩০-৪০ কিলোমিটার বেগে হাওয়া বইতে পারে। রবিবার কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, হাওড়া, হুগলির দু’-এক জায়গায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। সাগর উত্তাল থাকবে।
ঝড় দুর্বল হয়ে গেলেও উপকূল এলাকা আবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বস্তুত, এ দিনই সেখানে আবহাওয়ায় পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। আকাশ দুপুর থেকেই মেঘলা। জেলাশাসক, মহকুমাশাসক এবং বিডিও অফিসগুলিতে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ফেরানো হয়েছে মৎস্যজীবীদের। এ দিন বিকেল পর্যন্ত জেলার প্রায় ৭০ শতাংশ আমন ধান তোলার কাজ হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি দফতর। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর (এনডিআরএফ) দু’টি এবং রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর (এসডিআরএফ) চারটি দল জেলায় এসেছে। এনডিআরএফের দু’টি এবং এসডিআরএফের দু’টি দলকে রাখা হয়েছে দিঘা ও কাঁথিতে। এসডিআরএফের একটি করে দল রয়েছে তমলুক ও হলদিয়ায়।
দিঘায় সমুদ্রস্নানে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রশাসন। তবে শুক্রবার সারা দিনই থিকথিকে ভিড় ছিল সৈকতে। দিঘা হোটেল মালিক সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক বিপ্রদাস চক্রবর্তী বলেন, ‘‘একের পর এক বাধা অতিক্রম করে চলতি সপ্তাহের শেষ থেকে পর্যটকদের ভিড় বাড়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় এসে শুরুতেই সব আশা চুরমার করে দিয়ে গেল।’’