ছবি: এএফপি।
শেষমেশ সুন্দরবনেই আছড়ে পড়ল অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, শনিবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ সাগরদ্বীপ ও ফ্রেজারগঞ্জের মাঝামাঝি জায়গা দিয়ে ডাঙায় প্রবেশ করতে শুরু করে বুলবুল। তখন তার সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গণেশকুমার দাস জানান, স্থলভূমিতে ঢোকার সময় বুলবুলের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১১৫-১২৫ কিলোমিটার। মাঝে তা ১৪৫ কিলোমিটারে ওঠে। সেই সর্বোচ্চ গতিবেগ তিন মিনিট স্থায়ী ছিল। স্থলভূমিতে প্রবেশ-পর্বটি ছিল ঘণ্টা তিনেকের। আবহবিদেরা জানান, স্থলভূমিতে ঢুকে শক্তি খোয়াতে শুরু করে বুলবুল। ঝড়ের বড় ধাক্কাটা কেটে গিয়েছে। তবে বৃষ্টির ভোগান্তি চলবে রবিবারও।
এক দশক আগে, ২০০৯ সালের ২৫ মে সুন্দরবনে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় আয়লা। তার সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। সেই ঝড়ে তছনছ হয়ে গিয়েছিল রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্ত। এ দিন বুলবুলের হামলা সেই স্মৃতি উস্কে দিয়েছে। বুলবুলের তাণ্ডবে কার্যত লন্ডভন্ড পরিস্থিতি হয়েছে সাগরদ্বীপ, বকখালি, নামখানায়। হয়েছে জলোচ্ছ্বাসও। প্রবল হাওয়ায় ভেঙে গিয়েছে গাছপালা, বাড়িঘর। মৌসুমি দ্বীপে ৭০ জনকে নিয়ে বিপদে পড়েছিল একটি ‘ক্রুজ’। সেটিকে নিরাপদ স্থানে আনা হয়। কলকাতায় গাছ পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও উপকূলীয় এলাকা থেকে কোনও প্রাণহানির খবর মেলেনি গভীর রাত পর্যন্ত। ঝড়ের দাপটে রাতে শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। মধ্য রাতে কলকাতায় ঝড়ের গতি ছিল ঘণ্টায় ৪৫-৫০ কিলোমিটার।
অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার কাজ তদারকি করতে শনিবার ছুটির দিনেও নবান্নে আসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্নের কন্ট্রোল রুমে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের মন্ত্রী জাভেদ খান, মুখ্যসচিব রাজীব সিংহ এবং বিপর্যয় মোকাবিলা সচিব দুষ্মন্ত নারিয়ালা মুখ্যমন্ত্রীকে উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে ঝড়ের মতিগতি ব্যাখ্যা করেন। ঝড় দুর্বল না-হওয়া পর্যন্ত নবান্নেই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বেরোন রাত সাড়ে দশটায়। রাতভর নবান্নে থাকেন চার জন সচিব স্তরের কর্তা।
সতর্ক: নবান্নের কন্ট্রোল রুমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রয়েছেন মুখ্যসচিব রাজীব সিংহ-ও। শনিবার। নিজস্ব চিত্র
মুখ্যমন্ত্রী জানান, উপকূলীয় এলাকায় বাড়িঘর ছেড়ে আসতে অনেকে আপত্তি করলেও প্রশাসন তাঁদের বুঝিয়ে শিবিরে নিয়ে এসেছে। ওই এলাকা থেকে মোট ১ লক্ষ ৬৩ হাজার মানুষকে সরানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১ লক্ষ ১২ হাজার জনকে রাখা হয়েছে ৩১৮টি ক্যাম্পে। বাকিরা নিরাপদ স্থানে বা আত্মীয়-পরিজনদের কাছে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, দিনের আলো না-ফোটা পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বলা যাবে না। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে ও ত্রাণের কাজ আরও ভাল ভাবে করতে রবিবার উপদ্রুত এলাকায় পুলিশের ড্রোন ‘দুর্দান্ত’কে ওড়ানোর পরিকল্পনা হয়েছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৫৫ হাজার, উত্তর ২৪ পরগনায় ৪৩ হাজার, পূর্ব মেদিনীপুরে ২৩ হাজার, হাওড়ায় সাড়ে ১০ হাজার, হুগলিতে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার, পশ্চিম মেদিনীপুরে প্রায় এক হাজার এবং কলকাতায় আড়াই হাজার মানুষকে ত্রাণ শিবিরে আনা হয়েছে। দুর্যোগের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর ১১ নভেম্বরের প্রশাসনিক বৈঠক আপাতত পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। সোমবারও উপদ্রুত এলাকায় স্কুল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের ছ’টি বিপর্যয় মোকাবিলা দল, ১০টি এনডিআরএফ দল, ১৩৩৫ জন অসামরিক প্রতিরক্ষার কর্মী পরিস্থিতি সামলাবেন। বিপর্যয়ের আশঙ্কা মাথায় রেখে ৫২টি নৌকো-সহ পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের সর্ব স্তরের কর্তাদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় কন্ট্রোল রুম খুলেছে কলকাতা ও হাওড়া পুরসভা। কলকাতায় বাম কাউন্সিলররাও নিজেদের এলাকায় কন্ট্রোল রুম খুলেছেন। কলকাতার পুর-কন্ট্রোল রুমে মেয়র ফিরহাদ হাকিম বসে কাজ তদারকি করেন। হাওড়ার পুর-কন্ট্রোল রুমে ছিলেন কমিশনার-সহ পদস্থ আধিকারিকেরা। কলকাতা ও উপকূলীয় জেলাগুলিতে সকাল থেকেই ফেরি বন্ধ ছিল। কলকাতার বিপজ্জনক বাড়ি থেকে লোকজনকে সরানো হয়েছে। তৈরি ছিল কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। গঙ্গাবক্ষেও পুলিশ টহল দিয়েছে। সকাল থেকে টানা বৃষ্টিতে মধ্য কলকাতা, বন্দর এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় জল জমে। দুপুরে বৃষ্টির সময় গাছ ভেঙে পড়ে কলকাতায় এক জনের প্রাণও গিয়েছে।
বুলবুলের আতঙ্কে সকাল থেকেই কাকদ্বীপের রাস্তাঘাট ছিল প্রায় জনশূন্য। সাগরদ্বীপে ৭০০টি মাটির বাড়ি ভেঙেছে। গোসাবায় ৩৪টি ও বাসন্তীতে ১০টি বাড়ি ভেঙেছে বলে রাত পর্যন্ত খবর। গোটা এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। বকখালি, সুন্দরবনের হোটেল, লজে বহু পর্যটক আটকে পড়েছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায় চাষের ক্ষতি হয়েছে। আতঙ্কের পরিবেশ ছিল উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদেও। পূর্ব মেদিনীপুরে কাঁথি দেশপ্রাণ ও খেজুরিতে মাটির বাড়ি ভেঙেছে। বন্ধ রাখা হয় হলদিয়া বন্দরের কাজকর্ম।
বুলবুল বঙ্গোপসাগরে দানা বেঁধেছিল ৭ নভেম্বর। গোড়ায় মনে করা হচ্ছিল, রাজ্যের কান ঘেঁষে বাংলাদেশে চলে যেতে পারে সে। কিন্তু অভিমুখ বদলে চলে এসেছে এ রাজ্যে। বেশি রাতের খবর, বুলবুল সামান্য দুর্বল হয়েছে। সুন্দরবনের উপরেই রয়েছে সেটি। আজ, রবিবার সকালে বাংলাদেশে ঢুকতে পারে।