ঝড় কেড়েছে মাথার ছাদ। বৃহস্পতিবার নন্দীগ্রামে। নিজস্ব চিত্র
মাটির বাড়ির চালের উপরে পড়ে রয়েছে উপড়ে যাওয়া গাছের গুঁড়ি। সামনে আর একটি গাছের গুঁড়ির উপরে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছেন বছর পঁয়তাল্লিশের এক মহিলা।
ঝড় শান্ত হওয়ার পরে বৃহস্পতিবার প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে নিজের বাড়ির সামনে এসেছিলেন নন্দীগ্রামের রেয়াপাড়ার ওই বাসিন্দা। ঝড় সর্বস্ব কেড়েছে তাঁর। ঝড় থামলেও ঘুরে দাঁড়াবেন কী করে! প্রশ্নের উত্তর জানা নেই ওই মহিলার মতো জেলার হাজার হাজার বাসিন্দার।
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, দিঘা-শঙ্করপুরে আশঙ্কার তুলনায় ক্ষতির বহর কম। অথচ, সব হিসেব ওলটপালট করে ‘আমপান’ তছনছ করেছে হলদিয়াকে। এই ঝড় প্রাণ কেড়েছে ছ’জন জেলাবাসীর। এঁদের মধ্যে রয়েছেন হলদিয়া শহরেরই তিনজন। মৃতরা হলেন হলদিয়ার ১ নম্বর ওয়ার্ডের রঞ্জিত সিংহ, প্রসেনজিৎ সিংহ, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের অলোক মাইতি, দেউলপোতের তপন দাস, রামনগর-২ ব্লকের শীতলা গ্রামের অন্নপূর্ণা প্রামাণিক এবং ভগবানপুর-২ ব্লকের মুগবেড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ছবি শীট। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। ঝড় তছনছ করেছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি, উপড়ে ফেলেছে কয়েক হাজার গাছ এবং বিদ্যুতের ক্ষতি। কৃষি জমিতে জল দাঁড়িয়ে ক্ষতি হয়েছে চাষবাসের। বুধবার বিকেল ৩টে পর থেকে জেলায় ঝড়ের দাপট ক্রমশ বাড়তে থাকে। তাতে জেলার নন্দীগ্রাম, দিঘা, রামনগর, কাঁথি, হলদিয়া ব্লকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, প্রায় ৪০০৮ স্কোয়্যার কিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২৫টি ব্লক এবং পাঁচটি পুরসভা। মোট ২২ লক্ষ ৭০ হাজার ৩৯৭ জন বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘর ভেঙেছে এবং ক্ষতি হয়েছে দু’লক্ষ ৫২ হাজার ৪২৮টি। বুধবার দুপুর পর্যন্ত মোট এক লক্ষ ৪৭২ হাজার বাসিন্দাদের ৮০০টি ত্রাণ শিবিরে সরানো হয়েছে।
ঝড়ে তমলুক জেলা হাসপাতাল চত্বরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৮টি গাছ ভেঙেছে। নার্সিং হস্টেল একাংশ এবং জেলা গ্রন্থাগারের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নন্দকুমারের বহিচবেড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা কৃষ্ণ মাইতি বলেন, ‘‘বুধবার সন্ধ্যায় প্রচণ্ড ঝড়ের সময় গাছ ভেঙে বাড়ির উপরে পড়েছে। কোনও রকমে ছুটে বেরিয়ে আসায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। এখন প্রতিবেশীর বাড়িতে রয়েছি।’’
এগরা মহকুমায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এগরা পুরসভা ও পটাশপুর-২ ব্লকে। এগরা মহকুমায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা ১৩ হাজার ৮৪৯টি। সম্পূর্ণ ভেঙে গিয়েছে এক হাজার ৪২৫টি মাটির বাড়ি। আংশিক ক্ষতি হয়েছে আট হাজার ৬৯৮টি। ঝড়ের কারণে মহকুমার ৬ লক্ষ চার হাজার ২৯০ জন মানুষ ক্ষতি গ্রস্ত হয়েছে। মহকুমার ১৫২টি ত্রাণ শিবিরে মোট ৬,৯৪৪ জনকে সরিয়ে আনা হয়েছে। ঝড়ে এগরা পুরসভা এূং পটাশপুর পূর্ব খাড়ে দু’জন আহত হয়েছেন। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
মহকুমার বিদ্যুতের তিনটি সাব স্টেশনের শতাধিক বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙেছে। গত ২৪ ঘন্টা সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ ছিল এগরা মহকুমায়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুধুমাত্র এগরা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এবং মহকুমা হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুত পরিষেবা চালু করা হয়েছে। মহকুমায় বিদ্যুৎ পরিষেবা স্বাভাবিক হতে আরও ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে বলে বিদ্যুৎ দফতর সূত্রের খবর। তবে শুধু এগরা নয়, গোটা জেলাতেই এ দিন বিদ্যুৎ পরিষেবা বিচ্ছিন্ন ছিল। এগরার মহকুমাশাসক অপ্রতিম ঘোষ বলেন, ‘‘ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে ত্রিপল এবং শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ির তালিকা তৈরি করে জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে।’’
পাঁশকুড়ার মাইশোরা, গোবিন্দনগর, কেশাপাট, রঘুনাথবাড়ি, পুরুষোত্তমপুর ইত্যাদি এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। কেশাপাটের হাতিশালে একটি বহু পুরনো গাছ ভেঙে। পুরুষোত্তমপুর বাজারের তমলুক-পাঁশকুড়া রাজ্য সড়কেও গাছ ভেঙে পড়ে। ভারি বৃষ্টিতে পাঁশকুড়া ও কোলাঘাট ব্লকের নিচু এলাকাগুলিতে জল জমে যায়। কোলাঘাট ব্লকের সিদ্ধা-১, ২, পুলশিটা, কোলা গ্রাম পঞ্চায়েত-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় জল জমে আনাজ চাষে ক্ষতি হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা কৃষি দফতরের সহ-অধিকর্তা মৃণালকান্তি বেরা বলেন, ‘‘পান, ফুল, আনাজের ক্ষতি হয়েছে। ব্লক থেকে রিপোর্ট সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে।’’
ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি প্রসঙ্গে জেলাশাসক পার্থ ঘোষ বলেন, ‘‘জেলার পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট রাজ্য সরকারের পাঠিয়েছি। পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা চালু, রাস্তাঘাট মেরামতি সহ পুনর্গঠনের কাজে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।’’
(তথ্য: আনন্দ মণ্ডল, গোপাল পাত্র)