আমপানের তাণ্ডবে ভেঙে গিয়েছে মৈপিঠের নদী বাঁধ।
বিঘের পর বিঘে মাঠ-ঘাট প্লাবিত। নোনা জলে ভাসছে মিষ্টি জলের রুই-কাতলা। বাঁচানো যায়নি ধান, মাঠের ফসলও। নদী বাঁধে উঠতেই দেখা গেল দূরে গ্রামবাসীরা মাথায় বস্তা নিয়ে পিছল কাদাতে দৌড়চ্ছেন পিঁপড়ের মতো লাইন দিয়ে। আর একটু কাছে যেতে ভয়ঙ্কর ছবিটা ফুটে উঠল।
আমপানের (প্রকৃত উচ্চারণে উম পুন) তাণ্ডবে প্রায় একশো ফুট এলাকা জুড়ে ভেঙে গিয়েছে নদী বাঁধ। ছেলে থেকে বুড়ো, বাড়ির মহিলা, ছেলেপুলে— সবাই তাকিয়ে রয়েছেন ওই বাঁধের দিকে। জোয়ারের আগে কি ঠেকনা দেওয়া যাবে? তা না হলে, ফের ভাসবে সুন্দরবনের মৈপিঠ। আয়লার থেকেও আমপান ভয়ঙ্কর ভাবে তাণ্ডব চালিয়েছে এই দ্বীপ এলাকায়।
দু’জন আপরিচিত মানুষকে দেখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছেন দেউল বাড়ির মধ্যগুড়গুড়িয়ার গ্রামবাসীরা। এক জন ভিড়ের মধ্যে থেকে বলে উঠলেন, ‘‘সরকারি বাবুরা এসেছে মনে হয়।’’ ভুল ভাঙিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘এখনও কেউ আসেননি?’’ যিনি বলছিলেন, তাঁর পুরো শরীরটা কাদায় মাখামাখি। প্রশ্ন শুনে তাঁর মেজাজটা যেন আরও চড়ে গেল। বললেন, “আমাদের কি দেখতে এসেছেন? সরকারি সাহায্য এলে কি আমরা এ ভাবে নিজেরাই বাঁধ তৈরি করতে আসতাম? নদীপথে বাবুরা দেখে চলে গেছেন। গ্রামে ঢোকেননি। যেন বউ দেখতে এসেছিলেন। আমরা লড়ছি ভাগ্যের সঙ্গে।”
আরও পড়ুন: কলকাতা যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ: জল, বিদ্যুতের দাবিতে অবরোধ বিভিন্ন এলাকায়
নাম জানতে চাইলাম, বললেন না। উল্টে, চলে যান এখান থেকে বলে ধমকই যেন দিলেন। বললেন, “আমাদের কাজ করতে দিন। আবার জোয়ার আসবে। বাঁধ তুলতে না পারলে ফের ভাসবে।”
কথা বাড়ালাম না।
তার পর ঠায় দাঁড়িয়ে দেখলাম কী ভাবে একজোট হয়ে লড়াই চালাচ্ছে বাঘের সঙ্গে ঘর করা এই মানুষগুলো। প্রতি বছরই কারও না কারও বাড়ির লোককে বাঘে টেনে নিয়ে যায়। বছরভর এ ভাবে লড়াই করে ওঁদের জীবিকা চলে। কেউ চাষ করেন, কেউ জঙ্গলে মৌমাছির চাক ভাঙতে যান। কেউ নদীতে কাঁকড়া, মাছ ধরে সংসার চালান। আর প্রতি বছরই বর্ষায় রয়েছে, প্লাবনের আশঙ্কা।
তছনছ সব কিছু। ভেসে গিয়েছে মাঠঘাট।
তবে, এ বার আগেই রুজিরুটিতে থাবা মেরেছে করোনা। দ্বীপের বাইরে যেতে পারছেন না ওঁরা। তার উপর আমপানের ছোবল। খাবারের জোগাড় করবেন, না কি আমপানের সঙ্গে যুঝবেন ওঁরা। আমপান যে ভাবে তছনছ করে দিয়েছে, তা ২০০৯ সালের আয়লার থেকেও ভয়ঙ্কর। বললেন ভোলা মণ্ডল। তাঁর কথায়: “এমন ঝড়ের তাণ্ডব আমার জীবনে এই প্রথম দেখলাম। চোখের সামনে ভেসে গেলে বাঁধ। সরকারি কোনও সাহায্য নেই। আমরা ছেলেরা প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে মাটি ভরে বাঁধ বানাচ্ছি। নদীর সীমানায় বাঁশের বেড় দিয়ে মধ্যিখানে মোটা করে মাটির বস্তা ভরছি। এ ভাবে কি আর গ্রামকে বাঁচানো সম্ভব, যদি সরকার এগিয়ে না আসে।”
আরও পড়ুন: আমপান: রাজ্যকে ১ হাজার কোটি টাকা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি মোদীর
বাঁধ মেরামতির কাজ শুরু করেছেন মৈপিঠের বাসিন্দারাই।
ভোলার কথার আক্ষেপের সুর শোনা অভিজিৎ দাসের গলাতেও। ওষুধের দোকান আছে তাঁর। নিজের পরিচয় দিতে দিতে তিনি বলতে লাগলেন, “বুধবারের ঘূর্ণিঝড়ের শক্তিতে শান্ত ঠাকুরান নদীটা যেন রাক্ষুসে হয়ে উঠেছিল। দোতলা বাড়ির সমান জলের ধাক্কায় গুঁড়িয়ে গিয়েছে নদী বাঁধের একাংশ। এখন দেখে মনে হছে যেন পথভোলা পথিক। আপন মনে বয়ে চলেছে ম্যানগ্রোভের অরণ্যে।”
গ্রামবাসীরা একসঙ্গে বলতে লাগলেন, ‘‘দেখুন না কী ভাবে ক্ষতি হয়েছে। মাঠের ফসল গেছে। খাব কী?’’
বাঁধের এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখলাম, দূরে জমির যে অংশটি উঁচু হয়ে আছে, সেখান থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। জনা পঞ্চাশেক মানুষ নদীর বাঁধ তৈরিতে হাত লাগিয়েছেন। লাইন দিয়ে মাটির বস্তা মাথায় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাঁধের দিকে। দিলীপ বেরার আক্ষেপ, ‘‘আয়লা, ফণী, বুলবুল, আমপান। গত ১১ বছরে একের পর এক ঝড়ের তাণ্ডব চলেছে। আমরা হেরে যাইনি দাদা। ফের হয়তো আরও একটা ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়বে। আমাদের দিন পাল্টাবে না।’’
ছবি: সোমনাথ মণ্ডল এবং অর্চিষ্মান সাহা।