আমপানের তাণ্ডবে উপড়ে গিয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি। ছবি: পিটিআই।
অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরতে ১৫০ ঘণ্টা। আমপান-তাণ্ডবের ছ’দিন পরে মঙ্গলবার অন্তত ৯৭ শতাংশ গ্রাহকের ঘরেই বিদ্যুৎ চলে এসেছে বলে দাবি করছে সিইএসসি। তবে সংস্থাই জানিয়েছে, তাদের ১ লক্ষ গ্রাহক এখনও বিদ্যুৎ পাননি। কলকাতা ও শহরতলির পরিস্থিতি কার্যত স্বাভাবিক বললেও রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সিইএসসি-র উপরে ক্রমাগত চাপ রেখে চলেছে সরকার। তাঁর বক্তব্য, বিচ্ছিন্ন ‘পকেট’ ছাড়া আমপান কবলিত ১০৩টি পুর এলাকার ৯৪টিতে পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক। কসবা, নেতাজিনগর, পাটুলি, রাজডাঙা, রিজেন্ট পার্ক, পর্ণশ্রী, মহেশতলা, বজবজ, জোকার মতো এলাকায় দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে রাজ্য জানিয়েছে।
মঙ্গলবার রাতের মধ্যে কলকাতা ও শহরতলির অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ ফিরলেও এখনও বঞ্চিত কয়েকটি এলাকা। লালবাজার জানিয়েছে, বেহালা, সরশুনা, যাদবপুর, পর্ণশ্রী, রামগড়, নেতাজীনগর-সহ অন্তত ৮টি এলাকায় সকাল থেকে জল এবং বিদ্যুতের দাবিতে রাস্তায় বসে পড়েন এলাকাবাসী। নাদিয়ালের কাঞ্চনতলায় অবরোধ থেকে গোলমালে স্থানীয় বিধায়ক ও ৮ জন পুলিশকর্মীও জখম হন। হাওড়ার আন্দুলের কিছু এলাকা, পাঁচলা, উলুবেড়িয়া, বাগনান, আমতার একাংশ এ দিনও বিদ্যুৎহীন ছিল। হুগলির শেওড়াফুলিতে সকালে জিটি রোড অবরোধে শামিল হন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান।
কলকাতায় নেতাজিনগর মোড় এবং সরশুনায় রাত পর্যন্ত অবরোধ চলেছে। কিছু এলাকায় আবার চার্লস ডারউইনের যোগ্যতমের টিকে থাকার তত্ত্বেরই কার্যত ফলিত প্রয়োগ। দলবল জুটিয়ে এক পাড়ার লোক অন্য পাড়ায় সিইএসসি-কর্মীদের ছিনিয়ে নিতেও কসুর করেনি। গত কয়েক দিনের মতোই। তাতে অবশ্য দূরত্ব বিধি শিকেয় উঠেছে। কিন্তু ছ’দিন ধরে বিদ্যুৎ, জলের অভাবে নাস্তানাবুদ নাগরিক-জীবন তখন কোভিড-আতঙ্কেও ভ্রুক্ষেপহীন।
আরও পড়ুন: ফিরছেন ২০ হাজার শ্রমিক, চিন্তায় রাজ্য
এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ নেতাজিনগরে জিডি বিড়লা স্কুলের সামনে দিনেদুপুরে কার্যত অপহরণ-নাট্যই দেখা গেল। গড়িয়া থেকে একটি গাড়ি ও চারটি মোটরবাইকে পুরুষ-মহিলারা দল বেঁধেই হাজির হয়েছিলেন। সিইএসসি-র মোটে দু’জন কর্মী সেখানে পৌঁছেছেন বলে খবর ছিল। গড়িয়ার এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘আমরা ওই দু’জনকেই বেছে নিই।’’ সিইএসসি-র গাড়িতে মহিলাদের মাঝে বসিয়ে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হল। কাছেই গাছতলা এলাকায় অবরোধ চলছে। দেখে গলিপথ ধরেন ‘অপহরণকারীরা’। কান টানলে মাথা আসার মতো এর পরেই গড়িয়ায় পৌঁছন সিইএসসি-র ইঞ্জিনিয়ারেরা। বিকেলের মুখে মুশকিল আসান। দুপুরে যাদবপুরে সিইএসসি-র ডিস্ট্রিবিউশন দফতরে গিয়ে দেখা গেল, রীতিমতো কাঁদোকাঁদো রামগড়ের জনৈক বাসিন্দা। ‘‘বাড়িতে ৮৬ বছরের মা, কিছু করুন দাদা!’’— বলছিলেন তিনি। একটু বাদে দেখা গেল, রামগড়ে সিইএসসি কর্মীদের আগলে রেখে কাজ করাচ্ছেন রাজনৈতিক দলের ‘ছেলেরা’। রিজেন্ট এস্টেটের বাসিন্দা জনৈক তরুণের কথায়, ‘‘ওয়র্ক ফ্রম হোম লাটে উঠেছে। হায়দরাবাদ, মুম্বইয়ে সহকর্মীদের বোঝাতে পারছি না, কলকাতার হতভাগ্যতম এলাকায় থাকি।’’
পঞ্চসায়র এলাকায় পর্যায় ক্রমে আলো ফিরতে শুরু করেছে সন্ধের দিকে। সার্ভে পার্কের প্রবীণ নাগরিক বিষ্ণুপ্রিয়া সরকার বললেন, ‘‘সন্ধ্যায় আলো ফিরলেও এটা অস্থায়ী সংযোগ। ফ্রিজ চালানোর সাহস করছি না।’’ রিজেন্ট এস্টেটের একাংশেও অস্থায়ী ব্যবস্থা। বিদ্যুৎকর্মীদের দাবি, নতুন খুঁটি বসিয়ে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা ফেরাতে আরও সময় লাগবে। তবে পর্ণশ্রীর পাড়ুই কাছা রোডের মতো কয়েকটি এলাকার কপালে শিকে ছেঁড়েনি রাত পর্যন্ত। ওই এলাকায় ৮০ বছরের তরুণ কুমার দাশগুপ্ত পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। তাঁর মেয়ে চৈতালি জানান, মা বাবা একাই থাকেন। অন্য এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বাড়িতে জল পৌঁছানো হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
অন্য রাজ্য থেকে লোক এনেও সিইএসসি-র ১৫০টি দল কাজ করছে বলে সংস্থার তরফে দাবি করা হয়েছে। সিইএসসি-র ভাইস প্রেসিডেন্ট (ডিস্ট্রিবিউশন) অভিজিৎ ঘোষ জানান, তাঁরা চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখছেন না। তবে কবে পরিস্থিতি পুরো স্বাভাবিক হবে বলে তার সময়সীমা বলতে চাননি তিনি।