আমপানের জেরে ঝড়ের গতিবেগ স্বল্প সময়ের জন্য ঘণ্টায় ১৯৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। প্রতীকী ছবি।
প্রায় দু’দশক আগেকার ভয়াবহ স্মৃতি উস্কে বঙ্গোপসাগরে ফের জন্ম নিল এক ‘সুপার সাইক্লোন’ বা মহা ঘূর্ণিঝড়। তবে দিল্লির মৌসম ভবনের আশ্বাস, আমপান নামের ওই ঘূর্ণিঝড় সুপার সাইক্লোনে পরিণত হলেও সে ওই ভয়াল চেহারা নিয়ে ডাঙায় আছড়ে পড়বে না। কাল, বুধবার সন্ধ্যায় সে দিঘা এবং বাংলাদেশের হাতিয়া দ্বীপের মাঝামাঝি কোনও জায়গা দিয়ে স্থলভূমিতে ঢুকতে পারে এবং সেই সময় তার যে-রূপ ধরার কথা, আবহবিদদের পরিভাষায় তাকে বলা হয় ‘এক্সট্রিমলি সিভিয়ার সাইক্লোন’ বা মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়।
আমপান স্থলভূমিতে ঢোকার সময় উপকূলবর্তী এলাকায় ঘণ্টায় ১৬৫-১৭৫ কিলোমিটার বেগে ঝড় বইবে। ঝড়ের গতিবেগ স্বল্প সময়ের জন্য ঘণ্টায় ১৯৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। উপকূলীয় এলাকায় প্রবল বৃষ্টি হবে। অতিভারী বৃষ্টি হতে পারে কলকাতাতেও। হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস, ঝড়বৃষ্টিতে সব চেয়ে ক্ষতি হতে পারে দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলার। ১৯৯৯ সালে ওড়িশায় সুপার সাইক্লোনে জনজীবন লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব এ বারের ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে সোমবার ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (পূর্বাঞ্চল) সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন জানান, আজ, মঙ্গলবার থেকেই গাঙ্গেয় বঙ্গে বৃষ্টি শুরু হতে পারে। বিকেলের পরে উপকূলে ঝোড়ো হাওয়া বইবে। কাল, বুধবার সকাল থেকে ঝোড়ো হাওয়া বইবে গাঙ্গেয় বঙ্গে কলকাতা-সহ উপকূলবর্তী জেলায়। বুধবার বিকেলের পর থেকে কলকাতা-সহ উপকূলের জেলাগুলিতে ঘণ্টায় ১১০-১২০ কিলোমিটার বেগে ঝড় এবং অতিভারী বৃষ্টির আশঙ্কা আছে। ভারী বৃষ্টি হবে দক্ষিণবঙ্গের প্রায় সব জেলাতেই। উপকূলে তিন থেকে ছয় মিটার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। উত্তর ওড়িশাতেও ঝড়ের প্রভাব পড়তে পারে বলে জানাচ্ছেন আবহবিদেরা।
আরও পড়ুন: তিন দুর্বিপাকে রাজ্যের পরীক্ষা, মানছেন মমতা
আরও পড়ুন: বেড়েই চলেছে গতি, বুধবার দুপুরে প্রবল বেগে আছড়ে পড়বে সুপার সাইক্লোন ‘আমপান’
ঝড়-হুঁশিয়ারি: ক্যানিংয়ের নিকারিঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের উদ্যোগে নদী-তীরবর্তী এলাকায় সতর্কবার্তা। ছবি: প্রসেনজিৎ সাহা।
আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, কাল, বুধবার মালদহ ও দুই দিনাজপুরে বৃষ্টি হতে পারে। বৃহস্পতিবার বৃষ্টি বা ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে সব জেলাতেই।আগুয়ান ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই প্রশাসনকেই উদ্বেগে ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এ দিন জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর (এনডিআরএফ) ডিজি-র সঙ্গে বৈঠক করেন। বাহিনীর ডিজি এসএন প্রধান জানান, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের জন্য মোট ৩৭টি বিপর্যয় মোকাবিলা দলকে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৫টি দলকে মোতায়েন করা হয়েছে উপকূলবর্তী এলাকায়। বাকি ১২টি দলকে রিজার্ভে রাখা হয়েছে। উপকূল এলাকা থেকে বাসিন্দাদের সরানোর সময় করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রক।
আমপান
উৎপত্তি দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন আন্দামান সাগর।
সম্ভাব্য লক্ষ্যস্থল
• বঙ্গের দিঘা থেকে বাংলাদেশের হাতিয়া দ্বীপের মাঝের অঞ্চল। আগামিকাল, বুধবার সন্ধেবেলা আছড়ে পড়তে পারে।
• তবে আবহবিদদের অনুমান, বঙ্গে হামলার আশঙ্কা বেশি। আছড়ে পড়ার সময় ঘণ্টায় ১৬৫-১৭৫ কিমি
বেগে ঝড় হবে। সর্বোচ্চ বেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১৯৫ কিমি। সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি।
শক্তিবৃদ্ধি
• সাগরের জলের তাপমাত্রা বেশি থাকলে জলীয় বাষ্প তৈরি হবে এবং তা শুষে শক্তি বৃদ্ধি করে। যে ভাবে আমপান ঘূর্ণিঝড় থেকে দ্রুত প্রবল, অতিপ্রবল থেকে সুপার সাইক্লোনে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস, ডাঙায় আছড়ে পড়ার আগে সে শক্তি খুইয়ে মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়ে (এক্সট্রিমলি সিভিয়ার সাইক্লোন) পরিণত হবে।
বিপদের আশঙ্কা
• দিঘা ও মন্দারমণি এলাকায় প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেওয়াল বালিয়াড়ি নষ্ট করে পর্যটনের বিকাশ।
• সুন্দরবন এখনও বুলবুলের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠেনি। বেশ কিছু ম্যানগ্রোভ অরণ্য নষ্ট হওয়ার ক্ষতি এখনও পূরণ করা যায়নি।
ঝড়ের ঠিকুজি
উৎপত্তির কারণ
প্রধানত ৬টি শর্তের কথা বলেন বিজ্ঞানীরা। সব ক’টি একসঙ্গে বিদ্যমান না-ও থাকতে পারে। এর মধ্যে প্রধান হল:
• সাধারণত প্রাক-বর্ষা (মূলত গ্রীষ্ম) ও বর্ষা-পরবর্তী ঋতুতে (বাংলায় হেমন্তকাল) ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়
• উৎপত্তিস্থল নিরক্ষীয় এলাকা (৫ ডিগ্রি অক্ষরেখার কাছাকাছি)।
সে ক্ষেত্রে পৃথিবীর আবর্তনের প্রভাবে ঝড়ের ঘূর্ণি তৈরি হয়
• সাগরের জলের তাপমাত্রা ২৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকতে হবে। জলীয় বাষ্প বেশি তৈরি হবে
• বাতাসে সামগ্রিক জলীয় বাষ্পের পরিমাণও বেশি থাকতে হবে
• বায়ুমণ্ডলের নীচের ও উপরের স্তরে তাপমাত্রার ফারাক থাকলে জলীয় বাষ্প দ্রুত ঘনীভূত হয়ে মেঘ তৈরি হয়
চরিত্র
• উত্তর গোলার্ধে হাওয়ার অভিমুখ ঘড়ির কাঁটার বিপরীতমুখী হয়। সাগর থেকে উপকূলে আছড়ে পড়ার পরে সে যত স্থলভূমির ভিতরে ঢোকে দ্রুত শক্তি খুইয়ে ফেলে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন নবান্নে জানান, ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে বলা হয়েছে জেলাশাসকদের। উপকূলে যাঁরা থাকেন, তাঁদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলিতে যথাসম্ভব বিধি মেনে রাখতে হবে বাসিন্দাদের। বিপর্যয় মোকাবিলায় সব ধরনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এনডিআরএফ, এসডিআরএফের দল প্রস্তুত আছে। নবান্নেও দিনরাত উপস্থিত থাকবেন প্রশাসনিক কর্তারা। দুই ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনকে বিশেষ ভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনে ঝড়ের বিপদ সামাল দেওয়ার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির বিষয়ে পদস্থ অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করেন বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। সুন্দরবনে নদীর কাছ থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে দিচ্ছেন বনকর্মীরা। ঝড়ের পরে ত্রাণকাজে নামবে বন দফতর। প্রতিটি বিট ও রেঞ্জ অফিসে চার দিনের রেশন মজুত রাখা হয়েছে। ঝড়ের আগে জলযানের বদলে ক্যাম্প অফিসে থাকতে বলা হয়েছে কর্মীদের। রাজ্যের সব চিড়িয়াখানাকে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন রাজ্যের জ়ু অথরিটি।
উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বিভিন্ন বন্যাত্রাণ কেন্দ্র ও স্কুলভবনে শিবিরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক জায়গা থেকেই বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ দিন সাগরের বিচ্ছিন্ন ঘোড়ামারা দ্বীপ থেকে শ’খানেক বাসিন্দাকে সাগরদ্বীপে সরিয়ে আনা হয়। দুই জেলাতেই বিভিন্ন জায়গায় দুর্বল নদীবাঁধ সারানো হচ্ছে। ক্যানিংয়ে নিকারিঘাটা পঞ্চায়েতের উদ্যোগে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের শ্রমিকদের নিয়ে বিপর্যয় মোকাবিলা দল গড়া হয়েছে। ৩০ জনের জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী পৌঁছে গিয়েছে হাসনাবাদে। পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী এলাকা থেকে রাত পর্যন্ত অন্তত ২৫ হাজার বাসিন্দাকে সরানো হয়েছে। কলকাতায় ঝড়ের সময় প্রাণহানি ঠেকাতে সব থানাকে নিজের এলাকার জরাজীর্ণ বাড়ির তালিকা তৈরি করতে বলেছে লালবাজার।