মহম্মদ সেলিম। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ধর্ম আসলে আফিমের মতো। দলের কোন কোন নেতা সেই ধর্ম-আফিমে ‘আসক্ত’, এ বার তা সরাসরি জানতে চাইল সিপিএম। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি গোটা দেশ জুড়ে ‘ত্রুটি সংশোধন’ অভিযান চালু করেছে। অভ্যন্তরীণ সেই মূল্যায়নের জন্য প্রতিটি রাজ্য কমিটি সমস্ত জেলায় একটি ফর্ম পাঠিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট মোট সাতটি প্রশ্নের তালিকা পাঠিয়েছে এরিয়া কমিটি পর্যন্ত। সেখানেই তারা নেতাদের কাছে জানতে চেয়েছে, তাঁরা ‘ধর্ম-কর্ম’ করেন কি না। সেই সঙ্গে এ-ও জানতে চেয়েছে, তাঁদের পরিবারে বিয়ে বা অন্যান্য পারিবারিক, সামাজিক অনুষ্ঠানে কোনও ‘রাজকীয় আয়োজন’ হয় কি না।
ওই প্রশ্নমালার সাত-এর ‘ক’-এ লেখা রয়েছে, ‘ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও কূপমণ্ডূক প্রথাগুলি আপনি কি অনুসরণ করেন?’ তার পর ‘গ’-এ প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘পরিবারে বিবাহ বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে বিলাসবহুল ব্যয় পরিহার করার ক্ষেত্রে আপনার ভূমিকা?’ সেই সঙ্গে নেতারা কতটা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পরিত্যাগ করতে পেরেছেন, তা-ও জানতে চেয়েছে দল। প্রত্যেক নেতাকে মুখবন্ধ খামে ওই প্রশ্নগুলির জবাব সংশ্লিষ্ট কমিটির সম্পাদকের হাতে জমা দিতে হবে।
ওই প্রশ্নাবলি ইতিমধ্যেই জেলায় জেলায় পৌঁছে গিয়েছে। তার পরে সেগুলি নিয়ে দলের মধ্যেই নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন নেতারা। তাতে মোটামুটি তিনটি অভিমত উঠে আসছে। ‘কট্টরপন্থী’ সিপিএম নেতাদের বক্তব্য, এত দিনে একটা ‘কাজের কাজ’ করেছে দল। কলকাতার এক নেতা বলেন, ‘‘পার্টিতে অনেকেই আছেন, মুখে বড় বড় কথা বললেও আদর্শগত অবস্থানে নড়বড়ে। তাঁরা বিপাকে পড়বেন।’’ অন্য একটি অংশের বক্তব্য, ‘‘ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা নিয়ে দলের প্রশ্ন করার অধিকার নেই। দলের পরিসরে কেউ তো আর মন্ত্র পড়ে না বা নমাজ পাঠও করে না। তা হলে এ সব জানতে চাওয়ার অর্থ কী?’’ তৃতীয় অংশের বক্তব্য, ‘‘এই ধরনের প্রশ্ন করে আসলে অনেককে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে দেওয়া হল। এতে এই দুর্দিনে লোক দল থেকে সরবে ছাড়া জুড়বে না।’’
ধর্মাচরণ নিয়ে সিপিএমে বিতর্ক কম নেই৷ প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তীর তারাপীঠের মন্দিরে পুজো দেওয়া নিয়ে দলে তীব্র বিতর্ক হয়েছিল। এমনকি, সিপিএমে থাকাকালীন রেজ্জাক মোল্লার হজযাত্রা নিয়েও কম হইচই হয়নি। যদিও সিপিএমের অনেক নেতার বক্তব্য, ‘‘দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ। তিনি আজীবন মাথায় পাগড়ি বাঁধতেন। যা তাঁর শিখ পরিচয় জানান দিত। তখন তো এত বস্তুবাদ দেখা যায়নি?’’ সিপিএমের হুগলি জেলা কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘‘আমাদের জেলায় এমনও নেতা আছেন, যাঁর পেশা পুরোহিতগিরি করা। তাঁকে কি সব ছেড়ে দিতে হবে?’’ যদিও খবর, হুগলির চন্দননগরের ওই যুব নেতা বেশ কিছু দিন আগেই ওই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
এ তো গেল সাধারণ ভাবে ধর্ম-কর্মের বিষয়। সিপিএমের রাজ্য নেতাদের অনেকের বক্তব্য, বিয়ে বা অন্যান্য পারিবারিক অনুষ্ঠানে দলের অনেক নেতার বৈভব প্রদর্শন সংক্রমণের আকার নিচ্ছে। যা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের ক্ষেত্রে সমীচীন নয়। এমনকি, জেলা ও রাজ্য কমিটির নেতার বিয়েতেও আড়ম্বর প্রকাশ পাচ্ছে বলে দল মনে করছে। প্রশ্নমালায় বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাইছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। সামগ্রিক ভাবে ত্রুটি সংশোধন অভিযানে সিপিএমের প্রশ্নমালা দলের মধ্যে নতুন বিতর্কের জন্ম দিতে চলেছে বলে মত অনেকের।