কেষ্টর জেলায় মার সিপিএমকে

বিরোধীরা মাথাচাড়া দিতেই একের পর এক হামলা

শুক্রবার নিজের বিধানসভা কেন্দ্র পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে জাঠায় নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তৃণমূলের বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শনিবার ওই জেলারই পিংলা এবং বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের ষাটপলশায় ফের হামলা হল সিপিএমের জাঠায়। কাঠগড়ায় সেই তৃণমূল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদাদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:২৪
Share:

প্রথমে মার। পরে জোর করে কান ধরানো হল সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক ধীরেন লেটকে। — নিজস্ব চিত্র।

শুক্রবার নিজের বিধানসভা কেন্দ্র পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে জাঠায় নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তৃণমূলের বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শনিবার ওই জেলারই পিংলা এবং বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের ষাটপলশায় ফের হামলা হল সিপিএমের জাঠায়। কাঠগড়ায় সেই তৃণমূল।

Advertisement

এ দিন বীরভূমের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ রামচন্দ্র ডোম এবং প্রাক্তন বিধায়ক ধীরেন লেটকে মারধর করা হয়। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে, এমন অবস্থাতেই জোর করে কান ধরানো হয় প্রবীণ প্রাক্তন বিধায়ককে। রামচন্দ্রবাবু ও ধীরেনবাবু ছাড়াও এ দিনের হামলায় সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদা, স্থানীয় বিধায়ক অশোক রায়, জোনাল সম্পাদক অরূপ বাগ-সহ জনা কুড়ি দলীয় কর্মী-সমর্থক জখম হন। এঁদের মধ্যে আট জন সিউড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি। অরূপবাবু ও অশোকবাবুর আঘাত গুরুতর।

সিপিএম তথা বামফ্রন্টকে রাজনৈতিক ভাবে অপ্রাসঙ্গিক বলে নিয়মিত কটাক্ষ করে থাকেন তৃণমূল নেতারা। তা হলে সেই বামেদেরই জাঠার উপরে একের পর এক হামলা কেন? বাম নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, তৃণমূল জমানার গত সাড়ে চার বছরে গ্রামাঞ্চলে সভা-সমাবেশ করার সাহস বিশেষ দেখাননি তাঁদের কর্মীরা। কলকাতার সমাবেশে জেলা থেকে নেতা-কর্মীরা এলেও নিজেদের এলাকায় শাসক দলের ভয়ে তাঁরা গুটিয়েই থাকতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ছবির বদল হচ্ছে। গ্রাম এলাকাতেও ভয় ভুলে পথে নামছেন বাম কর্মীরা। সেই সব মিছিলে ভিড়ও ভালই হচ্ছে। আর তাতেই প্রমাদ গুনছে শাসক দল। বিধানসভা ভোটের মুখে বিরোধী শক্তির মাথাচাড়া দেওয়া অঙ্কুরে বিনাশ করতেই উপর্যুপরি এই হামলা।

Advertisement


জখম সিপিএমের ময়ূরেশ্বর জোনাল সম্পাদক অরূপ বাগ শনিবার তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

তৃণমূল সরকারের ‘অপশাসন’-এর প্রতিবাদে এবং বিভিন্ন দাবিতে গত ১৪ নভেম্বর থেকে রাজ্য জুড়ে বাম-জাঠা শুরু হয়েছে। ২০০৬ সালের পর যে নন্দীগ্রাম বামেদের হাতছাড়া হয়েছিল, সেখানে গত মঙ্গলবার রবীন দেবের নেতৃত্বে বিরাট মিছিল হয়েছে। একদা সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি খেজুরিতে এখন তৃণমূলেরই রমরমা। তা সত্ত্বেও সূর্যবাবুর নেতৃত্বে খেজুরি থেকে হেঁড়িয়া পর্যন্ত পদযাত্রায় ব্যাপক ভিড় হয়েছে। বাম নেতাদের দাবি, পরিবর্তনের পরে যাঁরা শাসক দলের দিকে ঢলেছিলেন, তাঁদের একটা বড় অংশ সন্ত্রাস-বিশৃঙ্খলা-দুর্নীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বামেদের দিকে ফিরতে শুরু করেছেন। সে জন্যই তৃণমূল আতঙ্কিত এবং অসহিষ্ণু হয়ে হামলার পথ নিচ্ছে।

বীরভূমের এ দিনের ঘটনা সম্পর্কে বিরোধী নেতাদের ব্যাখ্যা, ভোটের ফলে ওই জেলায় তৃণমূল প্রায় নিরঙ্কুশ হলেও বিরোধীদের উপস্থিতি একেবারে মুছে যায়নি। গত পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে সেখানে মাথাচাড়া দিয়েছিল বিজেপি। পাড়ুই তার প্রমাণ। সিপিএম করা অনেকেই ভিড় জমিয়েছিলেন বিজেপির পতাকার তলায়। কিন্তু ইদানীং বিজেপির পালে ভাটার টান। ফলে ফের ভিড় বাড়ছে সিপিএমে। সেই জনসমর্থনকে হাতিয়ার করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বামেরা। তার ফলেই তৃণমূলের সঙ্গে সংঘাত বাধছে তাদের। এ দিন ময়ূরেশ্বর ও পিংলার ঘটনার পরে সূর্যবাবু বলেন, ‘‘সরকার ও শাসক দল মানুষকে ভয় পেয়েছে। তাই আমাদের উপর আক্রমণ হচ্ছে।’’ হামলার প্রতিবাদে ময়ূরেশ্বরের কোটাসুরে সোমবার সভা করবেন সূর্যবাবুরা।


জখম বিধায়ক অশোক রায়। ছবি: অনির্বাণ সেন।

তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করে বামেদের ‘গ্রাম দখলের’ তত্ত্ব হাজির করেছেন। শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অভিযোগ, বামেরা জাঠার নাম করে জোর করে গ্রাম দখলের চেষ্টায় নেমেছিল। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘জনভিত্তিশূন্য দল সিপিএম কলকাতায় পাথর ছুড়ে দেখল, তেমন জমল না। তাই এখন জাঠার নামে জোর করে গ্রাম দখলের জন্য অত্যাচার করছে।’’ যার উত্তরে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর বক্তব্য, ‘‘তৃণমূলের মহাসচিব বলেছেন, ওরা কেন গ্রামে যাবে? এক গ্রামের লোক তো আর এক গ্রামে যাবেই! তাঁদের এই অধিকার আছে! মুখ্যমন্ত্রী অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। আর তাঁর দল বিরোধীদের প্রতি চরম অসহিষ্ণুতা দেখাচ্ছে!’’

পার্থবাবুর আরও অভিযোগ, যে রাস্তায় মিছিলের জন্য পুলিশ-প্রশাসনের অনুমতি ছিল, তার থেকে অন্য রাস্তায় চলে গিয়েছিল সিপিএমের মিছিল। সিপিএমের সমাবেশে ভিড়কে শাসক দল কি ভয় পাচ্ছে? পার্থবাবুর জবাব, ‘‘ভয় কেন পাব? ওরা কোন ভোটে জিতেছে?’’ বস্তুত, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, সিপিএমকে ভয় পাওয়ার মতো ‘দুর্দশা’ তাঁদের হয়নি! তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলেরও কটাক্ষ, ‘‘প্রচার পেতেই সিপিএম নাটক করছে।’’

বামেদের অভিযোগ, বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের ষাটপলশায় এ দিন সকালে পুলিশের সামনেই তাদের জাঠায় হামলা চালিয়েছে তৃণমূল। আক্রান্ত বিধায়ক অশোকবাবুর কথায়, ‘‘পুলিশ তৃণমূলের দুষ্কৃতীর হাত থেকে আমাদের রক্ষার চেষ্টাই করেনি। উল্টে মজা দেখেছে।’’ শুধু তা-ই নয়, প্রাক্তন বিধায়ক ধীরেনবাবুকে কান ধরিয়ে বলানো হয়, ‘আর সিপিএম করব না’। সেই ছবি মোবাইল ক্যামেরা-বন্দিও করা হয়। প্রাণে বাঁচাতে অরূপবাবুরা এক জনের বাড়িতে ঢুকে পড়েন। পরে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সাহায্যে সিপিএম নেতাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।


জাঠায় আক্রান্ত সিপিএম জোনাল কমিটির সদস্য চিত্ত বেরা। শনিবার রামপ্রসাদ সাউয়ের তোলা ছবি।

পশ্চিম মেদিনীপুরেও তিন জায়গায় এ দিন আক্রান্ত হয়েছে বাম জাঠা। সবং লাগোয়া পিংলার জলচকে মিছিল শুরুর আগেই তৃণমূলের সবং ব্লক কমিটির সদস্য তরুণ মিশ্রের নেতৃত্বে দলীয় কর্মীরা জমায়েতে হামলা চালায়। লাঠির ঘায়ে জখম হন তিন জন। সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক তরুণ রায়ের নেতৃত্বাধীন জাঠায় হামলা চলে দাসপুরে। নিজ নাড়াজোলের কাছে স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক মমতা ভুঁইয়ার ছেলে কুমারেশের নেতৃত্বে শাসক দলের লোকজন মিছিল থামানোর চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। বাম কর্মীদের প্রতিরোধে অবশ্য শেষমেশ পিছু হঠে তারা। ঝাড়গ্রামের ডিহিবাদিনা গ্রামেও আক্রান্ত হওয়ার পরে বাধা এড়িয়ে মিছিল এগোয়। এ দিন বর্ধমানের বারাবনির মদনপুর গ্রামেও সিপিএমের জাঠায় বাঁশ-লাঠি নিয়ে হামলার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। জখম হন চার জন।

রাজ্য পুলিশের আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মার কাছে জানতে চাওয়া হয়, বামেদের এই কর্মসূচি পুলিশকে আগাম জানানো হয়েছিল। পুলিশের অনুমতিও ছিল। এমনকী মিছিলে পুলিশ পাহারাও ছিল। তা সত্ত্বেও কেন হামলা হল? অনুজ বলেন, ‘‘আমরা দুই জেলার এসপি-র কাছ থেকে রিপোর্ট চেয়েছি।’’ বীরভূমের জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমারের মোবাইল এ দিন বেজে গিয়েছে। তিনি এসএমএসেরও জবাব দেননি। আর পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ ফোনে বলেন, ‘‘জেলার বাইরে আছি।’’ তবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খড়্গপুর) অভিষেক গুপ্তের দাবি, ‘‘এলাকায় যথেষ্ট পুলিশ ছিল। যেখানে গোলমাল হয়েছে, পুলিশই সামলেছে।’’

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর অভিযোগ, ‘‘মানুষের উপর আস্থা হারিয়ে হতাশা থেকে তৃণমূল হামলা করছে।’’ কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়াও বলেন, ‘‘শাসক দলের সহিষ্ণুতা না থাকলে মুশকিল। রাজ্যে কোনও সরকার বা শৃঙ্খলা আছে বলে তো মনে হচ্ছে না!’’ এই পরিস্থিতিতে আগামী দিনে বিরোধীদের একজোট হয়ে শাসকের হামলা প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন অধীর। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘ভোট যত এগিয়ে আসবে, এই ধরনের ঘটনা আরও ঘটাবে তৃণমূল। কারণ ওদের পায়ের তলার মাটি সরছে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement