২০১৬-র ২০ অক্টোবর সিঙ্গুরের জমিতে সর্ষেবীজ ছড়িয়ে চাষের সূচনা করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র
সিঙ্গুর ও টাটা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মিথ্যাচার’ করছেন বলে সরব হল সিপিএম। প্রায় একই সুর অন্য দুই বিরোধী দল বিজেপি ও কংগ্রেসেরও।
ন্যানো প্রকল্প করতে আসা টাটাকে তিনি তাড়াননি বলে বুধবার শিলিগুড়িতে মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তার প্রেক্ষিতে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘মিথ্যা বলতে বলতে মানুষ এমন জায়গায় যায়, যে মিথ্যাকেই সত্য বলে ভাবতে শুরু করে! উত্তরবঙ্গে গিয়ে আবার নতুন করে কিছু মিথ্যা বলেছেন। মমতা মাথায় বন্দুক ধরে ট্রিগার টিপে দিলেন বলেই সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যেতে হল, সেই কথা তো রতন টাটাই বলেছিলেন। আর জমির প্রশ্নে রাজ্যপালকে মধ্যস্থ করে আলোচনা হয়েছিল। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কার্যত দু’হাত জোড় করে বলেছিলেন, আমাদের বিরুদ্ধে যা রাজনৈতিক লড়াই করার করুন। কারখানাটা হতে দিন। কিন্তু নিজের জেদের জন্য তৃণমূল নেত্রী শুধু একটা কারখানা নয়, রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনা এবং তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করেছেন!’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকের আরও দাবি, ‘‘যা অন্যায় করেছেন, সেই অপরাধ স্বীকার করে মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন। মিথ্যাচার বন্ধ করে কল-কারখানা তৈরির চেষ্টা করুন।’’
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কটাক্ষ, ‘‘মিথ্যায় ওঁর ডক্টরেট পাওয়া উচিত! উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে গিয়ে বাংলার মানুষের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, তাই তাঁদের এখন আসল কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর টাটা যে বলেছিলেন মমতা ট্রিগার টিপে দিলেন, খুবই ভুল করেছিলেন। পারলে টাটার শাস্তির ব্যবস্থা করুন!’’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছেন, তিনি এত প্রকল্প করেছেন, জোর করে জমি নেননি। সুজনবাবুদের আবার পাল্টা প্রশ্ন, হাজারখানেক মানুষ কাজ করেন, এমন কোন কারখানার উদ্বোধন ১১ বছরে মুখ্যমন্ত্রী করেছেন?
প্রশাসনিক মহলের একটি সূত্র মনে করাচ্ছে, বাম আমলে সিঙ্গুরের পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় লগ্নি টানতে শিল্প তালুক তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করেছিল রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম। সিঙ্গুর-পর্বের পরে ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অধিগ্রহণ করা জমি দিয়ে গড়া শিল্প তালুক অনেক। যেমন, পানাগড় শিল্প তালুক (১৫০০ একর), পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর শিল্প তালুক (২৫০০ একর), বর্ধমানের এরোট্রোপলিস প্রকল্প (১৮০০ একর), পশ্চিম মেদিনীপুরে বিদ্যাসাগর শিল্প তালুক (৭৫০ একর, সিঙ্গুরের ঘটনার আগে প্রায় ২৫০ একর অধিগ্রহণ করা হয়), নৈহাটির ঋষি বঙ্কিম শিল্প তালুক (৬০ একর)। অন্য দিকে, নিজেরা জমি কিনে কারখানা গড়তে গিয়ে সমস্যায় পড়ে ট্র্যাক্টর্স ইন্ডিয়ার মতো সংস্থা। প্রয়াত প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনও সেই সময়ে বারবার দাবি করতেন, রাজ্যের বহু জায়গায় শিল্পের জন্য নির্বিঘ্নে জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে বিরোধীদের রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল বলেই সমস্যা হয়েছিল।
বিরোধী দলনেতা, বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী টুইট করে বলেছেন, ‘‘সত্যি কথা আপনার কাছে অপ্রিয় হলেও আমি কিন্তু বলতে অভ্যস্ত। টাটা মোটর্সকে আপনি তাড়িয়েছেন। এমনই কর্মফল যে, এই রাজ্য থেকে টাটাকে তাড়িয়ে তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নষ্ট করা হল আবার এখন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সেই টাটারই সানন্দের কারখানায় ‘অন জব ট্রেনিং’-এর জন্য এখানকার তরুণদের চিঠি দিয়েছেন!’’ বর্ধমানে এ দিন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারেরও বক্তব্য, ‘‘প্রতিদিন মিথ্যা বলেন, আজও বলেছেন। নতুন কিছু নয়!’’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর তোপ, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী রাজনীতিক। কখনও তথ্যনির্ভর কথা বলেন না।’’ কিন্তু সিঙ্গুরে আইএনটিইউসি-র পতাকা নিয়ে অধুনা প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়-সহ কংগ্রেসের অনেক নেতাকেই তো জমি আন্দোলনে দেখা গিয়েছিল? অধীরবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সুব্রত মুখোপাধ্যায় গিয়েছিলেন, আমিও তো গিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরে জমির প্রশ্নে রফার একটা প্রক্রিয়া হয়েছিল, যাতে কারখানাটা হতে পারে। কিন্তু তৃণমূল নেত্রী সে সব মীমাংসা মানেননি। স্বয়ং টাটাই তো ট্রিগারের কথা বলে গিয়েছিলেন।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির মন্তব্য, ‘‘আসলে এই সব মিথ্যা দাবির মধ্যে কোথাও একটা অপরাধের বোধ আছে। রাজ্য থেকে পুঁজি এবং মেধা অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে। এখন এই সব বলে শিল্প মহলকে কি বার্তা দিতে চাইছেন?’’