সাংগঠনিক রক্তক্ষরণের মধ্যেও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়াই করার কৌশল নিয়েছে সিপিএম। ফাইল চিত্র।
সাড়ে চার বছর আগে ২০১৬ সালের ভোটের পর বিভিন্ন জেলায় বেদখল পার্টি অফিসগুলি সম্প্রতি খুলতে শুরু করেছে সিপিএম। বিধানসভা ভোটের পর গত লোকসভা ভোটেও সিপিএম তথা বামফ্রন্টের ‘রক্তক্ষরণ’ অব্যাহত থেকেছে। বরং রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসাবে উত্থান হয়েছে বিজেপি-র। কিন্তু তার এক বছরের মধ্যে সিপিএম পার্টি অফিস খোলার মতো ‘শক্তি’ সঞ্চয় করতে পেরেছে।
সিপিএমের নেতারা যদিও বলছেন, তাঁর বৈধ নথিপত্র দেখিয়েই পার্টি অফিস ফেরানোর কাজ শুরু করেছি। জেলার পার্টি কমরেডরাই সে কাজ করছেন।’’ কিন্তু একান্ত আলোচনায় দলের একাংশ স্বীকার করে নিচ্ছে, শাসকদলের তরফে তেমন ‘বাধা’ তো থাকছেই না। উল্টে প্রশাসনের ‘প্রচ্ছন্ন সহায়তা’ পাওয়া যাচ্ছে।
শাসকদল তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্বের একটা বড় অংশ মনে করেন, রাজ্যে বিজেপি-র সাম্প্রতিক ‘বাড়বাড়ন্ত’ ঠেকাতে রাজনৈতিক ভাবে বিরোধী পরিসরকে ভাগ করা উচিত। কিন্তু মাত্রই কয়েকটি জেলা ছাড়া সিপিএম এবং কংগ্রেস যে ভাবে দিন দিন ক্ষয়িষ্ণু শক্তি হিসাবে পরিচিত হচ্ছে, তাতে বিরোধী ভোট বিজেপি-র বাক্সে যাওয়ার প্রবণতাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওই নেতারা মনে করছেন, এই পরিস্থিতিতে ‘কৌশলগত’ ভাবে বিরোধী সিপিএমকে কিছু পরিসর ‘ছেড়ে দেওয়া’ উচিত।
আরও পড়ুন: বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসের ভিতরে তৃণমূলের পতাকা, মমতার রোডশোর আগেই বিতর্ক
আগামী বিধানসভা ভোটের নির্ঘন্ট প্রকাশের এখনও কয়েক মাস দেরি আছে। কিন্তু সব রাজনৈতিক দলই ভোটের সলতে পাকানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে। সাংগঠনিক রক্তক্ষরণের মধ্যেও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়াই করার কৌশল নিয়েছে সিপিএম। সঙ্গে এলাকায় এলাকায় পার্টি অফিস খুলে হারিয়ে যাওয়া জমি ফিরে পেতে চাইছে তারা। ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর থেকেই রাজ্যে রাজনৈতিক জমি হারাতে শুরু করেছিল সিপিএম। শাসকদল তৃণমূলের ‘আগ্রাসনেই’ একের পর এক পার্টি অফিস হাতছাড়া হতে শুরু করে তাদের। কিছু কিছু এলাকায় পার্টি অফিস থাকলেও তা খোলার লোকজন পাওয়া দুষ্কর হচ্ছিল। কিন্তু গত কয়েক মাসে সিপিএমের বিভিন্ন এরিয়া কমিটির পার্টি অফিসের তালা খুলতে শুরু করেছে। কীভাবে সম্ভব হচ্ছে সেটা? সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘আমরা বৈধ কাগজপত্র দেখিয়েই পার্টি অফিস ফেরানোর কাজ শুরু করেছি।’’
গত পঞ্চায়েত ভোটে ডায়মন্ড হারবার লোকসভা এলাকায় কোথাও প্রার্থী দিতে পারেনি বিরোধীরা। সেখানেই একটি পার্টি অফিস উদ্ধারে সাফল্য পেয়েছে সিপিএম। ডায়মন্ড হারবারে লকডাউনের আগে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বিধানসভা কেন্দ্র সাতগাছিয়ার (এলাকা পুনর্বিন্যাসের কারণে যা এখন বজবজ বিধানসভার অংশ) বিড়লাপুরের পার্টি অফিসটি দখল করে নিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু পুজোর আগেই সেই অফিসটি পুনরুদ্ধারে সফল হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম। জেলা সম্পাদক তথা প্রাক্তন সাংসদ শমীক লাহিড়ি বলছেন, ‘‘বিড়লাপুরের পার্টি অফিস তো বটেই, ভাঙড়ে বেদখল হয়ে যাওয়া পার্টি অফিসও আমরা ফিরিয়ে এনেছি।’’
আরও পড়ুন: তাঁর মতোই লক্ষ্য অমর্ত্য সেন, সরব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
২০১১ সালে রাজ্যে বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় সিপিএমের বহু পার্টি অফিসে লালঝান্ডার নিশান মুছে জোড়াফুলের তেরঙা পতাকা উড়েছিল। সেই অধ্যায়ে পিংলা এলাকার বহু পুরোনো এসএফআইয়ের পার্টি অফিসটিও হাতছাড়া হয়েছিল। জেলা এসএফআইয়ের সম্পাদক প্রসেনজিৎ মুদির কথায়, ‘‘ওরা অনেক পার্টি দখল করে নিয়েছিল। পিংলার এসএফআই পার্টি অফিসটাও নিয়ে নিয়েছিল। অনেকদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়ে গত বছর ডিসেম্বর মাসে আমরা ওই অফিস পুনরুদ্ধার করি।’’ হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের সিপিএম নেতা শ্যামল মাইতি আবার বলেছেন, ‘‘হলদিয়ায় আমাদের বৈধ কোনও পার্টি অফিস দখল হয়নি ঠিকই। কিন্তু লুঠপাট ও ভাঙচূর করে সেগুলি ধংস করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো আমরা নতুন করে ঠিকঠাক করে খুলেছি।’’
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে দিল্লির যোজনা কমিশনের দফতরের সামনে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে সিপিএমের তৎকালীন রাজ্যসভা সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিক্ষোভের নামে হেনস্থা করার অভিযোগ ওঠে। ঘটনাচক্রে, তারপরেই সিপিএমের একের পর এক পার্টি অফিস দখল হয়ে যায়। কিন্তু গত এক বছরে সিপিএম সে সব ‘বেহাত’ হয়ে যাওয়া পার্টি অফিস ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে। সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক নেতার কথায়, ‘‘রাজ্যে ক্ষমতা বদলের পর বিভিন্ন ইউনিয়ন সিটু থেকে হাতবদল হয়ে তৃণমূলের হয়ে গিয়েছিল। সেগুলো আর ফেরানো যাবে না পার্টি ধরেই নিয়েছিল। কিন্তু জেলা স্তরে সিপিএম সহ ছাত্র-যুব সংগঠনের যে পার্টি অফিসগুলি বেহাত হয়েছিল, তার অনেকগুলিই ফেরানো গিয়েছে। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক সাহায্য মেলেনি ঠিকই। কিন্তু তেমনই কোনও বাধার সম্মুখীনও হতে হয়নি।’’ রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিপিএমের রাজ্য কমিটির নেতা অনাদি সাহু বলছেন, ‘‘বেশিরভাগ পার্টি অফিস আমরা ফিরে পেয়েছি। তবে জেলা পার্টির কমরেডরাই সেই কাজ করেছেন।’’
সিপিএমের এই ‘জমি’ ফিরে পাওয়া বিধানসভা ভোটে তাদের ফলাফলের উপর (আসলে বিরোধী পরিসরের উপর) কোনও প্রভাব ফেলবে কি না, তা এখনই বলা কঠিন। কিন্তু রাজ্য রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহে ‘বিনা বাধায়’ সিপিএমের পার্টি অফিস পুরনরুদ্ধার করতে পারার ঘটনা নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা যোগ করছে।