পথের ভুল শোধরাতে রাত পোহালেই শহরে আসছেন প্রকাশ কারাটেরা। আর কংগ্রেসের হাত ধরে রাখার জন্যই বঙ্গ সিপিএমের মধ্যে সুর আরও জোরালো হচ্ছে! দিল্লি না জেলা— কাদের কথা রাখবেন, চাপে পড়েছেন সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসুরা।
বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার সিদ্ধান্ত দলের রাজনৈতিক লাইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না বলে রায় দিয়েছে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি। তারই পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে লাইন সংশোধনের পন্থা নিয়ে আলোচনা করতে কাল, রবিবার আলিমুদ্দিনে রাজ্য কমিটির বৈঠকে আসছেন সীতারাম ইয়েচুরি, কারাট, এস আর পিল্লাই, এম এ বেবি, মানিক সরকারের মতো পলিটব্যুরোর সদস্যেরা। কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের আগে বিভিন্ন জেলা থেকে রাজ্য নেতৃত্বের কাছে যা মতামত এসেছে, তার সিংহভাগই জোট বজায় রেখে চলার পক্ষে। শুধু তা-ই নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় বামপন্থী কর্মী-সমর্থকেরাই রীতিমতো প্রচার শুরু করে দিয়েছেন, কারাটদের ফরমান মেনে বাংলায় দল চালানোর দিন শেষ! বাংলায় সিপিএমকে বেঁচে থাকতে গেলে নিজের ভাল বুঝে নিজের মতো চলতে হবে। পার্টি লাইন ঘিরে বিতর্কে সিপিএমে এমন চড়া বিভাজন সাম্প্রতিক কালে নজিরবিহীন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন এ রাজ্যে এমন বার্তাও প্রচার হচ্ছে, ‘কমরেড, একটা কথা মনে রাখবেন। আপনার বাড়িতে তৃণমূল আগুন দিলে প্রকাশ কারাট নেভাতে আসবেন না। পাশের বাড়ির কংগ্রেসি ভাইটাই আসবেন। তাই জোটবদ্ধ লড়াই জরুরি’। মনমোহন সিংহের ইউপিএ-১ সরকারের উপর থেকে পরমাণু চুক্তিকে ঘিরে বামেরা সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর থেকেই বঙ্গ ব্রিগেডের কাছে কারাট শিবির অপ্রিয়। কিন্তু এ বার বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের মধ্যে বিতর্কের জেরে যে ভাবে বাংলার নিচু তলার নেতা-কর্মীদের আক্রমণের মুখে পড়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, বাম শিবিরের অনেককেই তা সেই কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজনের স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে! সিপিএমের জেলা স্তরের এক নেতার কথায়, ‘‘তাত্ত্বিক লাইন নিয়ে অহেতুক বিতর্ক চালিয়ে গেলে নীচের তলায় পার্টিটা ফাঁকা হয়ে যাবে। বিরোধী রাজনীতিতেও আমরা জায়গা হারিয়ে ফেলব। প্রয়োজনে তাই রাজ্য পার্টির এখন নিজের পথ বেছে নেওয়া উচিত!’’
জেলায় জেলায় জোটবদ্ধ লড়াইয়ের পক্ষেই যে মত ভারী, তার আরও উদাহরণ মিলছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম থেকে। আসন সমঝোতার জেরে জেলা থেকে নির্বাচিত সিপিএম ও কংগ্রেসের চার জন বিধায়ককে সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করেছে নব ব্যারাকপুর-বিশরপাড়া জোনাল কমিটি। সেখানে বিশেষ অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান ও বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীকে। অনুষ্ঠানের বিষয়ে শুক্রবারই বিধানসভায় বিরোধী দলনেতার ঘরে গিয়ে মান্নানের সঙ্গে কথা বলেছেন সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য। তৃণমূলের বিপুল সাফল্যের মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনায় বিরোধী শিবির থেকে যে কয়েক জন বিধায়ক জিতে এসেছেন, তার মধ্যে কংগ্রেসের সংখ্যাই বেশি। তবু যে ভাবে যৌথ সংবর্ধনা আয়োজনে সিপিএম উদ্যোগী হয়েছে, তার মধ্যেই বার্তা স্পষ্ট। দলের জেলা সম্পাদক গৌতম দেব জ্যোতি বসুর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে এ দিনই দলীয় মুখপত্রে যে কলম ধরেছেন, সেখানেও কংগ্রেস সম্পর্কে তাঁদের মনোভাবের ইঙ্গিত রয়েছে।
বিতর্কের মধ্যে সরাসরি না গিয়েও দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবু টুইট করেছেন, ‘‘গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সংগ্রাম তীব্রতর করে তোলাই কমরেড জ্যোতি বসুর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা হবে। যিনি আজীবন এই দু’টোর জন্যই লড়াই করেছিলেন।’’ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার স্বার্থেই কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে চলার সওয়াল করে এসেছেন সূর্যবাবুরা। দলের রাজ্য কমিটির এক সদস্য বলছেন, ‘‘যে সব রাজ্যে পাঁচশো ভোট পেলেও শুধু সেমিনার করে পার্টি চলে, সেখানে এত তাত্ত্বিক বিতর্ক চলতে পারে। যেখানে মমতার বিরুদ্ধে ভোটে লড়ে বেঁচে থাকতে হবে, সেখানে জোটবদ্ধ হয়ে চলা ছাড়া এখন পথ নেই।’’ বাংলায় নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে কংগ্রেস ভেঙে বেরিয়ে তৃণমূল গড়েছিলেন, সেই উদাহরণও টানছেন কেউ কেউ!
এখন কারাটেরা কোন পথে যেতে চান, সিপিএমে উৎকণ্ঠা তা নিয়েই!