ঘাসফুলে ভোট চাইতে মাঠে হাতুড়ে, আশা-কর্মী

ছাগলকে রোগ-প্রতিষেধক টিকা দিতে বাড়িতে এসেছিলেন প্রাণিবন্ধু। চিকিৎসার ফাঁকেই গৃহস্থকে জানালেন নানা সরকারি প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধার কথা। কথায়-কথায় তাঁর আর্জি, ‘‘১৯ নভেম্বর ভোটটা ঘাসফুলেই দিন।’’

Advertisement

কেদারনাথ ভট্টাচার্য

মন্তেশ্বর শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:১০
Share:

ছাগলকে রোগ-প্রতিষেধক টিকা দিতে বাড়িতে এসেছিলেন প্রাণিবন্ধু। চিকিৎসার ফাঁকেই গৃহস্থকে জানালেন নানা সরকারি প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধার কথা। কথায়-কথায় তাঁর আর্জি, ‘‘১৯ নভেম্বর ভোটটা ঘাসফুলেই দিন।’’

Advertisement

চেম্বারে বসে স্টেথো দিয়ে রোগীকে পরীক্ষার মাঝেই গ্রামীণ ডাক্তার (হাতুড়ে) টুকরো কথায় বোঝাচ্ছেন, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নয়নে কী-কী করেছে রাজ্য। সেই সঙ্গে পরামর্শ, ‘‘ভোটটা কিন্তু তৃণমূলকেই দেওয়া উচিত।’’

অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে যাওয়া আসন্নপ্রসবাকে কেন্দ্রের কর্মী বা রাঁধুনিরা সুযোগ পেলেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন ‘দিদি’র দলের কথা। একই প্রচার চলছে কেন্দ্রে খাবার নিতে আসা বাচ্চাদের মায়েদের মধ্যেও।

Advertisement

বামেদের চার দশকের শক্ত ঘাঁটি বর্ধমানের মন্তেশ্বরে ফাটল ধরেছিল গত বিধানসভা ভোটে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে তৃণমূলের কাছে আসনটি খোয়ায় তারা। কিন্তু তার ছ’মাসের মধ্যে ফের পরীক্ষা সেখানে। এ বার আর কান ঘেঁষে (গতবারের ব্যবধান মাত্র ৭০৬ ভোটের) নয়, ভাল ব্যবধানে জিততে প্রচারে গেরস্থের উঠোন বা হেঁসেলে ঢুকে পড়ার কোনও সুযোগ ছাড়ছে না শাসকদল।

বাম জমানাতেও বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট-প্রচার করতে দেখা যেত মহিলা সমিতির সদস্যদের। তৎকালীন শাসকের হয়ে নিয়মিত মিছিল-পথসভা করত কিছু শিক্ষক সংগঠন। কিন্তু মন্তেশ্বরের কৃষিজীবী, দিনমজুর, গৃহবধূদের একটা বড় অংশ মানছেন, কোনও ভোটেই এক সঙ্গে নানা পেশার লোককে কোনও দলের হয়ে এ ভাবে প্রচারে দেখেননি তাঁরা।

মন্তেশ্বরে ভোটে জেতার কয়েক মাস পরেই মারা যান তৃণমূল বিধায়ক সজল পাঁজা। উপ-নির্বাচনে তাঁর ছেলে, বছর ছাব্বিশের সৈকত পাঁজাকে প্রার্থী করেছে দল। তৃণমূল সূত্রের খবর, এ বার এই কেন্দ্রের অন্তর্গত সবক’টি (১৭) পঞ্চায়েতে তৃণমূল-স্তরে ময়দানে নামানো হয়েছে দলের ঘনিষ্ঠ স্থানীয় গ্রামীণ চিকিৎসক, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী বা প্রাণিবন্ধুর মতো নানা পেশার লোকেদের, কাজের সূত্রে এলাকায় যাঁদের বেশ পরিচিতি রয়েছে। সেই সূত্রেই কাজের ফাঁকে চলছে প্রচার।

কেমন সে প্রচার? তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, দলের জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) তথা মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ ভোট ঘোষণার পরে নানা কর্মিসভায় দলের নিচুতলাকে বুঝিয়েছেন, বড় সভায় ভিড় করানোর বদলে প্রতি বাড়িতে দশ বার করে গেলে ফল হয় বেশি। মন্ত্রী বলেছেন, ‘বারবার বাড়ি গিয়ে আবেদন জানানোয় ভোটার যেন বলতে শুরু করেন, ‘আর আসতে হবে না, ভোটটা আপনাদেরই দেব’। তৃণমূল নেতাদের বিশ্বাস, নেতাদের মুখে রাজনীতির তত্ত্বের তুলনায় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী বা প্রাণিবন্ধুদের কথায় চিঁড়ে অনেকটাই বেশি ভিজবে।

তবে প্রচার শুধুই তৃণমূল-স্তরে আটকে নেই। প্রচার-পর্ব প্রাথমিক দেখাশোনার দায়িত্ব রয়েছে ব্লক স্তরের নেতাদের উপরে। ব্লক নেতাদের উপরে নজরদারির দায়িত্বে রয়েছেন দলের এক-এক জন বিধায়ক বা জেলা নেতা। ১৭টি পঞ্চায়েত সে ভাবেই ভাগ করে দিয়ে সামগ্রিক সমন্বয়ের কাজটি করছেন মন্ত্রী স্বপন।

দলের এত বাড়বাড়ন্তের সময় প্রচারে এত কৌশল লাগছে কেন তৃণমূলের? সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ ওসমান গনি সরকার, কংগ্রেসের বুলবুল আহমেদ শেখ বা বিজেপি প্রার্থী বিশ্বজিৎ পোদ্দারেরা জোর গলায় বলছেন, ‘‘ওদের প্রতি মানুষের ভরসা নেই বুঝেই প্রচারে নানা রকম রাস্তা নিতে হচ্ছে তৃণমূলকে’’ বা ‘‘গায়ের জোর দেখানোর নতুন ফিকির এটা।’’

তবে শাসকদলের অন্দরের খবর, এ ধরনের প্রচার-কৌশলের কারণ একাধিক। প্রথমত, নিজে বড় ব্যবধানে জিতলেও গ্রামীণ বর্ধমানে কয়েকটি আসনে দল সামান্য ভোটে উতরনোয় তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রশ্নের মুখে পড়েন স্বপনবাবু। এ বার যাতে তেমন পরিস্থিতি না হয়, সে জন্য এত কোমর কষা। দ্বিতীয়ত, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে দলের অনেক কর্মী-সমর্থক নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছেন। তাঁদের চাঙ্গা করতে এলাকা ধরে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তৃতীয়ত, দলের কোন্দলের প্রভাব যাতে প্রচারে না পড়ে, নানা পেশার লোকজনকে তাই মাঠে নামানো হয়েছে। চতুর্থত, জেলায় একটি মাত্র উপনির্বাচন বলে সম্মিলিত শক্তি কাজে লাগিয়ে প্রচারের এই ‘মডেল’ কতটা কার্যকরী, তা পরখ করে নেওয়া হচ্ছে। সফল হলে, অন্য সময়ে এই ‘মডেল’ ব্যবহারের ভাবনা রয়েছে দলের অন্দরে। তা ছাড়া, ব্যবধান বাড়িয়ে এলাকায় বিরোধীদের অস্তিত্বহীন বলে প্রমাণ করতে চাওয়ার ইচ্ছেটাও রয়েছে।

তাই কি? স্বপনবাবু বলেছেন, ‘‘দল যেমন নির্দেশ দিয়েছে, শুধু সে ভাবে কাজ করছি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement