করোনা আক্রান্তের চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে।—নিজস্ব চিত্র।
হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর অভিযোগে স্বাস্থ্য কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই মামলা রুজু করল। বুধবার থেকেই সব সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম এটাই। কিন্তু এই কমিশনই আবার ভর্তি হওয়ার প্রাক্কালে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলি আগাম ৫০ হাজার টাকার বেশি নিতে পারবে না বলে সুপারিশ করেছে! শুধু তাই নয় ১২ ঘণ্টার মধ্যে তা দিতে না পারলে রোগীকে স্থানান্তর করতে হবে।
প্রশ্ন একটাই রোগীর যদি বিমা থাকে, তা হলে এই অগ্রিমের প্রশ্ন ওঠে কোথা থেকে? আবার অনেক রোগীর টাকা থাকলেও, এই রোগের পরিমণ্ডলে ১২ ঘণ্টার মধ্যে টাকা জুটিয়ে আনা সম্ভব না-ও হতে পারে। তাঁদের ক্ষেত্রেই বা কী হবে, যদি মেনে নিই বাঁচার অধিকার বাজারই নির্ধারণ করবে? উত্তরটা অস্পষ্টই থেকে গেল।
বাজার ও বাঁচার অধিকার
আসলে গোটা আলোচনাটা মূলে রয়েছে দু’টি প্রেক্ষিত। এক, ভারতে স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবসায় বাজারের চল এবং দুই, কোভিডের মতো পরিস্থিতে সামলানোর লড়াইয়ে আর্থিক লাভের ভূমিকা।
আরও পড়ুন: রাম জন্মভূমি ট্রাস্টের প্রধান পুরোহিত করোনা আক্রান্ত
অনেকেরই মনে থাকবে, বছরখানেক আগে রাজ্যের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ নিয়ে হইচই হওয়ার কথা। তখন কলকাতার এক প্রখ্যাত বেসরকারি হাসপাতালের শীর্ষ কর্তা বলেছিলেন যে, প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতালই এক বিশেষ আর্থিক শ্রেণিকে পরিষেবা দেওয়ার জন্য বাজারে এসেছে। চিকিৎসা প্রার্থীদের উচিত তাঁদের পকেট মেপে সেই হাসপাতালেই যাওয়া, যেটি তাঁদের জন্য তৈরি। যুক্তি অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু কোভিডের মতো পরিস্থিতিতে যখন গোটা দেশই সুস্থ হওয়ার যুদ্ধে রত, সেই পরিস্থিতে কি শুধুই লাভের নিক্তিতে পরিষেবার অধিকার মাপা হবে? কেউ ভুল বোঝার আগেই বলি, এর মানে এই নয় যে, হাসপাতালগুলো নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে কোভিড যুদ্ধে নামবে! কিন্তু অভিযোগ যদি ওঠে যে, চিকিৎসার খাতে ২৫ লক্ষ টাকা অযৌক্তিক কি না, তখন তো নীতির প্রশ্নটা ওঠেই।
কোভিড উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গোটা দেশই সুস্থ হওয়ার যুদ্ধে রত।
আর এটা আটকাতেই হারিয়ানার মতো রাজ্য কোভিড চিকিৎসার খরচ বেঁধে দিয়েছে। যে সমস্ত হাসপাতাল এনএবিএইচ তালিকাভুক্ত নয়, সেখানে ভেন্টিলেটরে থাকা কোভিড রোগীকে দিনে ১৫ হাজার টাকা, আর এনএবিএইচ তালিকাভুক্ত হাসপাতালে এই খরচ ১৮ হাজার টাকার বেশি দাবি করা যাবে না। চিকিৎসার বিভিন্ন স্তরে ও বিভিন্ন মাপের বেসরকারি হাসপাতালে খরচ দৈনিক ৮ হাজার থেকে ১৮ হাজারের মধ্যে রাখার সীমা সরকার থেকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। যাতে কোভিডের মতো পরিস্থিতিকে হাসপাতালগুলি দাঁও মারার মওকা বলে ধরে না নিতে পারে।
একটা কথা কিন্তু আমাদের এখানে মনে রাখতে হবে। হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ডাক্তারদের উপরই আমাদের রোষ। আমরা ভুলে যাই যে ডাক্তাররা কিন্তু চিকিৎসার দাম নির্ধারণ করেন না। করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
আর আমাদের রাজ্যে কোভিড মৃত্যুর এই জোয়ারের মূলে কিন্তু অনেকেই দেখছেন ত্র্যহস্পর্শ— চিকিৎসার খরচ মেটানোর অক্ষমতা, চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর অনাস্থা এবং বেসরকারি চিকিৎসা পরিষেবার অদক্ষতা। এই তিনটেতেই ডাক্তারদের থেকেও দায় অনেক বেশি পরিকাঠামোর, যা একচেটিয়া ব্যবসার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে।
চিকিৎসার বাজার
সরকারি হিসাব বলছে আমাদের দেশে শয্যা সংখ্যার হিসাবে বেসরকারি হাসপাতালগুলির পাল্লাই ভারী। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিকাশ বাজপেয়ীর গবেষণা বলছে, এক দশক আগেও দেশে ১০ লক্ষ ৩৭ হাজারের মতো শয্যা ছিল বিভিন্ন হাসপাতাল মিলিয়ে। তার মধ্যে ৮ লক্ষ ৩৩ হাজার শয্যাই ছিল বেসরকারি হাতে! অর্থাৎ, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বড় অংশই বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে।
হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে মানুষের ক্ষোভ।
এই চিত্র কিন্তু এখনও একই। শয্যা সংখ্যা গত কয়েক বছরে বাড়লেও তার পাল্লা এখনও বেসরকারি দিকেই ভারী। মার্কিন দেশের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় ও সেন্টার ফর ডিজিজ ডাইনামিক্স, ইকনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্সের এই বছরের এপ্রিল মাসে করা সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে এখন ১৯ লক্ষ শয্যা আছে আর তার সিংহ ভাগই আছে পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের সাতটি রাজ্যে। গোটা দেশে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ২৫ হাজার ৭৭৮ এবং তার পাশে বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৪৩ হাজার ৪৮৭! অর্থাৎ জনসংখ্যার একটা বড় অংশের কাছে সেই বেসরকারি হাসপাতালই ভরসা, অপ্রতুল সরকারি পরিষেবার কারণে।
চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে যদি বাজারের নিয়মে দাম নির্ধারিত হয় তা হলে চাহিদার তুলনায় জোগান কম হলে, অসুখ হলে বাঁচার খরচ পেটের মূল্যেই চোকাতে হবে। বিশেষ করে আমাদের দেশে যখন প্রতি হাজারে মাত্র ০.৫৫টি মতান্তরে ০.৭টি হাসপাতাল শয্যা থাকে আমার আপনার ব্যবহারের জন্য! যেখানে কিউবায় এই সংখ্যা ৫-এর উপরে! আমাদের বাছতে হচ্ছে আজকে বাঁচা আগামীতে পেট ভরানোর চিন্তার বিনিময়ে।
এ কথা ঠিক যে, এই রাজ্যের একটা বিরাট সংখ্যার মানুষের চিকিৎসার ভার নেয় সরকারি হাসপাতালগুলো। এববং সেখানে চিকিৎসা হয় বিনামূল্যে। তবু, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে চাহিদার তুলনায় যে জোগান অপ্রতুল হয়ে পড়ে। সেখানেই আসে বেসরকারি ক্ষেত্রের দাঁও মারার প্রবণতা। এই ক্ষেত্রকে যাঁরা লাভের অঙ্কের হিসাবে দেখছেন এবং যাঁদের জোগানদার হিসাবে সংখ্যা ভারী, তাঁরা যে এই পরিস্থিতিকে দাঁও মারার মোক্ষম সুযোগ হিসাবেই দেখবেন তা তো স্বাভাবিক। অর্থনীতির অঙ্কও তাই বলছে। কারণ, স্বাস্থ্য ব্যবসায় চাহিদা-জোগানের অঙ্কে তো একচেটিয়া ব্যবসার পরিসর অনেক দিন আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছে!
আরও পড়ুন: মৃত্যুর নিরিখে ব্রিটেনকে টপকালেও আশা জাগাচ্ছে সংক্রমণ ও সুস্থ হওয়ার হার