সুজিত বসু এবং সব্যসাচী দত্ত (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
দু’বছর, নাকি আড়াই বছর? ঠিক কত বছর তাঁর ফোন থেকে সুজিত বসুর ফোনে কোনও কল বা টেক্সট যাওয়া-আসা করেনি, মনে করতে বেশ খানিক ক্ষণ ভাবনাচিন্তা করতে হল তাঁকে। এ দিনও যে ফোন করে প্রথমটায় সাড়া পাননি এবং যোগাযোগের আশা যে প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন, সে কথাও মুচকি হাসি নিয়ে বেশ অকপটেই স্বীকার করলেন। কিন্তু খোঁজটা না পাওয়া পর্যন্ত একটু দুশ্চিন্তাই হচ্ছিল, এই রকম একটা ভঙ্গিও করলেন। কোভিড পজিটিভ চিহ্নিত হয়ে আপাতত গৃহবন্দি রাজ্যের দমকল মন্ত্রী সুজিত বসু। আর সেই সূত্র ধরেই দু’বছর বা আড়াই বছর পরে আবার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হল এক কালের রাজনৈতিক ‘সহকর্মী’ সব্যসাচী দত্তের। কয়েক মিনিট ধরে দারুণ সৌজন্যের আলাপচারিতাও চলল। আর এই গোটাটাই ঘটল আবার সব্যসাচী বিজেপি দফতরে বসে থাকাকালীনই।
একই দলে ছিলেন দীর্ঘ দিন, একই এলাকায় রাজনীতি করেছেন। এক জন বিধাননগরের বিধায়ক এখনও। আর এক জন কিছু দিন আগে পর্যন্তও ছিলেন ওই বিধাননগরেরই মেয়র। কিন্তু সেই একই দলে থাকাকালীনও সুজিত বসু আর সব্যসাচী দত্তের সম্পর্ক কতটা ‘মধুর’ ছিল, সে কথা সল্টলেক, রাজারহাট, নিউটাউন জুড়ে সুবিদিত।
বিধননগরের মেয়র হওয়ার বাসনা যে সুজিতেরও ছিল, সে কথা কারও অজানা নয়। কিন্তু ২০১৫-র ধুন্ধুমার নির্বাচনের পরে সুজিত বসু, কৃষ্ণা চক্রবর্তীদের টেক্কা দিয়ে সব্যসাচী দত্তই হাসিল করে নিয়েছিলেন মেয়র পদ। ক্রমশ আরও বেড়েছিল দলের অন্দরের টানাপড়েন। কৃষ্ণা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সব্যসাচী আর সুজিতের লড়াই মাঝে-মধ্যে অতিষ্ঠ করে তুলতে শুরু করেছিল নবান্নের সর্বোচ্চ মহলকেও।
আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে করোনা সংক্রমণে রেকর্ড, আক্রান্ত ৩৯৬, মৃত্যু ১০ জনের
মেয়র পদে থাকাকালীনই অবশেষে বিদ্রোহ করেছিলেন সব্যসাচী দত্ত। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঘরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বীকে বধ করে ফেলতে সুজিত সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন বলে বিধাননগরের তৃণমূল কর্মীরাই স্বীকার করেন। সব্যসাচী শেষ পর্যন্ত বিদায়ও নিয়েছিলেন মেয়র পদ থেকে। তার পরে বিদায় নিলেন তৃণমূল থেকেই। কিন্তু বিধাননগরের ময়দান সুজিতের জন্য ফাঁকা হয়ে যায়নি তার পরেও। ইমারতি সাপ্লাই-এর ব্যবসা থেকে অটো ইউনিয়ন বা রিকশাচালক সংগঠন, কোথাওই সুজিত একচ্ছত্র হয়ে উঠতে পারেননি। ফোন কল বা টেক্সট বিনিময় না হওয়ার কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না।
এ হেন সুজিত বসু এখন কোভিড-১৯ পজিটিভ। তাঁর স্ত্রী-ও পজিটিভ। দু’জনেই গৃহবন্দি করে নিয়েছেন নিজেদের। চিকিৎসাও নিচ্ছেন বাড়িতে থেকেই। আর সব্যসাচী দত্ত সদ্য বেশ কিছুটা উত্থানের মুখ দেখলেন বিজেপিতে। দলের রাজ্য সম্পাদক পদ পেলেন সোমবার।
নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পরে মঙ্গলবারই বিজেপির রাজ্য দফতরে গিয়েছিলেন সব্যসাচী। সেখানে পৌঁছে সব্যসাচীর প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজটি এ দিন ছিল সুজিত বসুকে ফোন করা। বিকেল ৪টের সামান্য পরে সুজিত বসুর নম্বরটা ডায়াল করলেন রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক। মুখমণ্ডলে মৃদু হাসি। ও পারে কী হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। ফোন খানিক ক্ষণ কানে ধরে থেকে নামিয়ে নিলেন। জানালেন, সুজিত ফোন ধরেননি।
কিন্তু হঠাৎ সুজিত বসুকে ফোনই বা করছেন কেন? ‘‘ও মা! খোঁজ নেব না? একজন অসুস্থ হয়েছেন খবর পেয়েছি, এত দিনের আলাপ তাঁর সঙ্গে। খোঁজ তো নিতেই হবে।’’ বলেন সব্যসাচী।
কিন্তু কল তো রিসিভড হল না। ‘‘তা হল না। কিন্তু আমি টেক্সট পাঠিয়ে দিয়েছি।’’ আবার টেক্সট! ‘‘হ্যাঁ, অবশ্যই। বিশ্বান না হলে দেখে নিন।’’ মোবাইলটা চোখের সামনে তুলে ধরলেন বিজেপির রাজ্য সম্পাদক। দেখা গেল তিন শব্দের বার্তা গিয়েছে সুজিত বসুর নম্বরে— ‘গেট ওয়েল সুন’ (দ্রুত সুস্থ হও)।
সব্যসাচীর কাণ্ডকারখানা দেখে তখন মুচকি হাসছেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিজেপির আরও বেশ কয়েক জন সামনের সারির মুখ। সুজিত বসু এবং তাঁর স্ত্রীয়ের শারীরিক অবস্থা এখন কেমন, সে বিষয়ে প্রত্যেকেই খোঁজখবর নিচ্ছেন। দমকল মন্ত্রী দ্রুত সুস্থ হন, এমন প্রার্থনাও তাঁরা করছেন। কিন্তু সব্যসাচী যে আসর তত ক্ষণে জমিয়ে তুলেছেন আর সে আসর থেকে সুজিত-সব্যসাচীর দীর্ঘ দিনের ‘মধুর’ সম্পর্কের যে সব কাহিনি তখন উঠে আসছে, তাতে মুচকি হাসি আটকে রাখার উপায়ও খুঁজে পাচ্ছেন না অনেকেই।
সুজিত ফোন ধরলেন না কেন? ‘‘হয়তো বিশ্রাম নিচ্ছেন,’’— চটপট উত্তর বিধাননগরের প্রাক্তন মেয়রের। কিন্তু তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়ে লোকসভা নির্বাচনে জিতে আসা এক সাংসদ রসিকতা করে বললেন, ‘‘ফোন ধরবে কী ভাবে? ট্যাপ হওয়ার ভয় নেই! রাজ্যের দমকল মন্ত্রী পদে থেকে বিজেপির রাজ্য সম্পাদকের সঙ্গে ফোনে কথা! ধড়ে ক’টা মাথা!’’ ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হল না কারওরই। আর সে সবের মাঝেই চমকে দিলেন সুজিত। দু’বছর পরে হোক বা আড়াই বছর, সুজিত বসুর নম্বর থেকে কল ঢুকল সব্যসাচী দত্তর নম্বরে।
বিকেল ৫টা বেজে ৯ মিনিট নাগাদ সুজিতের রিং ব্যাক সব্যসাচীকে। সুজিতের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতেই ফোন করেছিলেন তিনি, জানালেন সব্যসাচী। ‘‘বউদি কেমন আছেন?’’— সে খোঁজও নিলেন। জানা গেল মন্ত্রী এবং মন্ত্রীর স্ত্রীয়ের শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে ভাল। উন্নতি হচ্ছে। তবে দুঃসংবাদও এল। মন্ত্রীর ছেলের টেস্ট রিপোর্টও পজিটিভ এসেছে বলে জানা গেল। যদিও কেউই গুরুতর অসুস্থ নন। বরং উপসর্গহীন।
আরও পড়ুন: বাড়ছে সরকারি বাস, অটো-ট্যাক্সিতে যত আসন এ বার তত যাত্রী
রিপোর্ট পজিটিভ এলেও উপসর্গ ছিল না বলেই হাসপাতালে যেতে হয়নি সুজিত বসু বা তাঁর স্ত্রীকে। কিন্তু গৃহবন্দি থাকাটা বাধ্যতামূলক। কারণ সংক্রমণ না-কাটা পর্যন্ত তাঁদের থেকে অন্যদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। সে কথা মাথায় রেখে আপাতত নিজেদেরকে অন্য সকলের থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রেখেছেন সুজিত। কিন্তু বৈপরীত্য সেখানেও। যাঁর সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন হয়েছিল, এই বিচ্ছিন্নতার দিনে তাঁর সঙ্গেই ফিরল যোগাযোগ।