বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থা সারদার আর্থিক নয়ছয়ের মামলায় জেলে থাকার সময়ে ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই সময়ে হেস্টিংস থানার পুলিশে অভিযোগ দায়ের করে যে, কুণাল একসঙ্গে অনেকগুলি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন প্রেসিডেন্সি জেলের ভিতরে। কুণালকে ভর্তি করানো হয় এসএসকেএম হাসপাতালে।
তখন এবং এখন কুণালের মধ্যে অনেক ফারাক। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
প্রেসিডেন্সি জেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে কি অন্যায় করেছিলেন কুণাল ঘোষ? এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে শুক্রবার। কিন্তু তার আগে রাজ্য সরকার ও কুণালের দাবি নিয়ে বিস্তর জটিলতা। সাক্ষীদের বয়ানের সঙ্গেও মিলছে না রাজ্যের দাবি। এই পরিস্থিতিতে সাংসদ-বিধায়কদের বিশেষ আদালত কী রায় দেয় সে দিকে তাকিয়ে রাজনৈতিক মহল। শুক্রবার রায় জানানোর কথা বিচারপতি তপনজ্যোতি ভট্টাচার্যের।
বছর আটেক আগে প্রেসিডেন্সি জেলে যখন কুণালের বিরুদ্ধে একসঙ্গে অনেক ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে, তার সঙ্গে আজকের সময়ের অনেক ফারাক। তখন কুণাল তৃণমূল সাংসদ থাকলেও সেই দলের কট্টর বিরোধী ছিলেন। সেই সময়ে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা সংক্রান্ত মামলায় তৃণমূলের অনেক নেতার গ্রেফতারির দাবি তুলেছেন নিয়মিত। এখন তিনি সেই দলেরই রাজ্য কমিটির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু শুক্রবার যে মামলার রায় ঘোষণা হতে চলেছে, সেই লড়াই আবার কুণাল এবং তাঁরই দলের সরকারের মধ্যে।
বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থা সারদার আর্থিক নয়ছয়ের মামলায় জেলে থাকার সময়ে ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর অসুস্থ হয়ে পড়েন কুণাল। সেই সময় অভিযোগ দায়ের হয় যে, কুণাল একসঙ্গে অনেকগুলি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন প্রেসিডেন্সি জেলের ভিতরে। কুণালকে ভর্তি করানো হয় এসএসকেএম হাসপাতালে।
সল্টলেকে সাংসদ-বিধায়কদের মামলার জন্য নির্দিষ্ট আদালতে দীর্ঘ দিন ধরেই কুণালের আত্মহত্যার চেষ্টা মামলার শুনানি চলছে। জেলের রক্ষী থেকে কয়েদি অনেকের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। জেলের বেশ কয়েকজন কর্মী এবং অফিসাররাও এই মামলার সাক্ষী ছিলেন। আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, সাক্ষীদের প্রায় সকলেই কুণাল অত ঘুমের ওষুধ একসঙ্গে খেয়েছিলেন বলে মানতে নারাজ। জেলে একসঙ্গে অত ঘুমের ওষুধ পাওয়া সম্ভব নয় বলেও তাঁরা আদালতে জানিয়েছেন। কুণালের কাছে প্রয়োজনের বেশি ওষুধ রয়েছে কি না তার খোঁজ নিয়মিত নেওয়া হত বলেও দাবি তাঁদের। কুণালের উপরে নজর রাখার দায়িত্বে থাকা অফিসাররা আদালতে এমনও জানিয়েছেন যে, রাতে একটি মাত্র ঘুমের ওষুধ খেতেন কুণাল। আর সেই ওষুধও কুণালের কাছে মজুত থাকত না। জেলকর্মীদের সামনেই তাঁকে ওষুধ দেওয়া হত। তাই একসঙ্গে অনেক ওষুধ পাওয়া এবং খাওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু জটিলতা রয়েছে অন্য জায়গায়। আত্মহত্যার অভিযোগ ওঠার সময় কুণালের শারীরিক পরীক্ষার পরে চিকিৎসক ও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা জানিয়ে দেন, তাঁর পেটের ভিতরে প্রচুর ঘুমের ওষুধ পাওয়া গিয়েছে। সেই সওয়ালই করেছেন এই মামলায় সরকার পক্ষের আইনজীবী গোপাল দাস, সোমা মণ্ডলেরা। আদালতে তাঁদের দাবি ছিল যে, কুণালের বিরুদ্ধ পুলিশের অভিযোগ প্রমাণিত। অন্য দিকে, কুণালের আইনজীবী অয়ন চক্রবর্তীর দাবি, কোনও সাক্ষীই বলেননি যে, কুণাল নিজে ওষুধ খেয়েছিলেন। কেউ তাঁকে ওষুধ খেতে দেখেছেন, এমনটাও নয়। পেটে অনেক ঘুমের ওষুধের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল মানে এটা প্রমাণ হয় না যে, তাঁর মক্কেল নিজে হাতে সেগুলি খেয়েছিলেন। তাই অভিযোগ প্রমাণিত বলে মানতে চাননি তিনি। একই সঙ্গে দাবি করেছেন, কেউ নিজেকে মারার চেষ্টা করে থাকলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়।
এই মামলার শুনানিতে বিচারপতি কুণালের সঙ্গেও কথা বলেছেন। আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, তিনি ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন কি না সেই প্রশ্নে কুণাল জানান, ন্যায় বিচার না পেয়ে মানসিক লড়াই থেকে একটা অবসাদ তৈরি হয়েছিল। তিনি সেই সময়ে এতটাই অবসাদে ছিলেন যে ঘটনার দিন সন্ধ্যার পরে কী কী হয়েছিল তাঁর কিছুই মনে নেই। এই প্রসঙ্গে কুণালকে প্রশ্ন করা হলে আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘আমি জানি কাল মামলার রায় দান। আমি নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে যাব।’’
কুণালের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ৩০৯ ধারায়। এই মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড অথবা আর্থিক জরিমানা হতে পারে। তবে এই ধারা নিয়ে দেশে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এ নিয়ে লোকসভাতেও এমন প্রস্তাব পাশ হয়েছে যে, আত্মহত্যার চেষ্টাকে অপরাধ বলা যাবে না। যদিও তা এখনও আইনে পরিণত হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট-সহ দেশের নানা আদালতও বিভিন্ন সময়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। জীবনের অধিকারের পরিপন্থী হিসাবে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে শাস্তি হওয়া উচিত বলে অনেকর মত। আবার একাংশ মনে করেন, শাস্তি নয়, কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে তাঁর চিকিৎসা প্রয়োজন। কারাগারের বদলে মনোবিদের কাছে পাঠানো দরকার।
এমনই নানা জটিলতার মধ্যে শুক্রবার রায় জানানোর কথা বিচারকের। রায় যাই হোক, তৈরি হবে বিতর্ক। কুণাল আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলা হলে দায় যেতে পারে জেল কর্তৃপক্ষের কাঁধে। অত ওষুধ একসঙ্গে জেলের এক কয়েদির কাছে গেল কী করে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কুণাল খাননি অথচ এসএসকেএম হাসপাতাল এবং ফরেন্সিক বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী তাঁর পেটে অত ঘুমের ওষুধ কী করে গেল তা নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যাবে।