ছবি পিটিআই।
কত আছে? কত প্রয়োজন? সংক্রমণ বৃদ্ধির হারের নিরিখে পরিকাঠামো কি পর্যাপ্ত? হাসপাতালের শয্যা-সঙ্কটে আপাতত এই প্রশ্নাবলির মুখে বঙ্গ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, শয্যার জোগানে সমস্যা কোথায়, স্বাস্থ্য দফতরের বুলেটিনেই তার আভাস রয়েছে। বুলেটিন জানাচ্ছে: রাজ্যে মোট কোভিড শয্যার সংখ্যা ১১,২৩৯। আর ১০৬টি সেফ হোমে ৬৯০৮ জনকে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। সব মিলিয়ে করোনা চিকিৎসায় শয্যা ১৮,১৪৭টি। হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, বুধবার অ্যাক্টিভ রোগীর সংখ্যা (১৮,৪৫০) ধরলে ৯৮.৬৫% শয্যাই ভর্তি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার জানান, এ রাজ্যে করোনা রোগীদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ ৫% এবং মাঝারি মানের অসুস্থ ৮%। মোট ১৩%। বুধবারের অ্যাক্টিভ রোগীর সংখ্যার বিচারে ৫% গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য ৯২৫টি আইসিইউয়ের প্রয়োজন হতে পারে। বুলেটিন বলছে, কোভিড হাসপাতালগুলিতে মোট আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৯৪৮টি।
চারটি রাজ্যে মোট শয্যা কত, তার পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে স্বাধীন গবেষণা সংস্থা সিডিডিইপি (সেন্টার ফর ডিজ়িজ় ডায়ানমিকস, ইকনমিকস অ্যান্ড পলিসি)। তাতে বলা হয়েছে, ২১ জুলাই পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বঙ্গে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ১,১৩,৫৩৫টি শয্যা আছে। রাজ্যের বুলেটিন বলছে, বঙ্গে এখন কোভিড অ্যাক্টিভ রোগীর সংখ্যা ১৮,৪৫০। সেই হিসেবে এ রাজ্যের মোট শয্যার মাত্র ১৬.২৫% ভর্তি রয়েছে।
কার্ডিয়াক সার্জন কুণাল সরকার জানান, সব করোনা রোগীর হাসপাতালে আসার প্রয়োজন হচ্ছে না। প্রয়োজন হলেও শয্যার অভাব হওয়ার যে কথা নয়, সিডিডিইপি-র পরিসংখ্যানই তা বলে দিচ্ছে। তা হলে শয্যার এত টানাটানি কেন?
আরও পড়ুন: লকডাউনেও রাজ্যে উড়ান চালু, মুখ্যমন্ত্রীর উষ্মায় মুখ্যসচিব
১৭ মার্চ বাংলায় প্রথম করোনা রোগীর হদিস মিলেছিল। কুণালবাবু বলছেন, ‘‘করোনা রোগীর ভর্তি প্রক্রিয়ায় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই গলদ রয়েছে। প্রথমে ঠিক করলাম, কোন কোন হাসপাতাল করোনা রোগী নেবে এবং কারা নেবে না। সংক্রমণের প্রথম তিন মাস পর্যন্ত এই ভাবনা ঠিক ছিল। কিন্তু এখন তো রোজ অন্তত আড়াই হাজার কেস হচ্ছে। তা হলে এই পদ্ধতিতে আটকে থাকব কেন!’’ তাঁর প্রশ্ন, কলকাতাকে বিভিন্ন জ়োনে ভাগ করে গুরুতর অসুস্থদের যাতে হাসপাতালে-হাসপাতালে ঘুরতে না-হয়, সেটা কেন নিশ্চিত করা হচ্ছে না? ওই কার্ডিয়াক সার্জনের কথায়, ‘‘তথাকথিত বড় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলি কে কতটা গা বাঁচিয়ে চলবে, ঠিক করে নিয়েছে। প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়া সত্ত্বেও বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার খরচ এখনও বেঁধে দেওয়া হল না কেন?’’
সমস্যা যেখানে
• উপসর্গ শনাক্তকরণে সমস্যা বা যথাসময়ে শনাক্ত না-হওয়া। করোনা ও নন-করোনা ভেদে রেফারের হয়রানি।
• গুরুতর, মাঝারি মানের অসুস্থতায় রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় সমন্বয়ে ঘাটতি।
• পড়শিদের আপত্তিতে উপসর্গহীন, মৃদু উপসর্গযুক্ত আক্রান্তদেরও শয্যা দেওয়ার চাপ।
• শয্যার জোগানে বিকল্প ‘সেফ হোম’, ছোট নার্সিংহোম। সেখানেও স্থানীয় বাসিন্দাদের কোভিড-ভীতি অন্তরায়।
• সামাজিক বয়কটের ভয়ে রোগ লুকোনোর প্রবণতা।
ডাক্তারেরা কী চান
• সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে পৃথক কোভিড ব্লক বা ভবন।
• এক-জানলা পদ্ধতি। কোন হাসপাতালে কী ধরনের শয্যা খালি আছে, তার তাৎক্ষণিক তথ্য থাকবে কোভিড ওয়াররুমের ড্যাশবোর্ডে।
• উপসর্গহীন, মৃদু উপসর্গযুক্ত রোগীদের ভর্তি নিতে চাপ সৃষ্টির অভিযোগ শুনলেই তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা।
• পড়শিদের সহমত অর্জনে পাড়ায় পাড়ায় করোনা স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন।
• সংক্রমণ লুকোনোর বিপদ নিয়ে জোরালো সচেতনতা প্রচার।
ডাক্তারদের একাংশের বক্তব্য, সঙ্কটজনক নন-কোভিড রোগী কোভিড ব্লক-হীন হাসপাতালে গেলে তাঁরা যে করোনায় আক্রান্ত নন, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হতে সমস্যা হচ্ছে। চিকিৎসার মূল্যবান সময় নষ্ট হওয়ায় বহু ক্ষেত্রে মৃত্যু হচ্ছে রোগীর। সরকারি চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘‘প্রতিটি হাসপাতালে কোভিড ব্লক চালু করার আগে আইসোলেশন ওয়ার্ড খোলা উচিত। যেখানে সঙ্কটজনক কোভিড সন্দেহভাজন রোগীদের রেখে নমুনা পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা দিয়ে স্থিতিশীল করতে হবে। গুরুতর অসুস্থকে এক হাসপাতাল থেকে অন্যত্র রেফার করা অমানবিক। অতিমারির মোকাবিলায় সকলকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এটা সরকারের একার দায়িত্ব নয়।’’
আরও পড়ুন: লকডাউন কড়া হাতে, সর্বত্রই সক্রিয় পুলিশ, রাজ্য জুড়ে যেন বন্ধের ছবি
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অনির্বাণ দলুইয়ের পর্যবেক্ষণ, আক্রান্তের নিরিখে জেলা-ভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। রোজ যত কোভিড রোগীর মৃত্যু হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে গড়ে ৭৫% কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনার। হুগলি, হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সংখ্যায় কম হলেও প্রাণহানি ঘটছে ধারাবাহিক ভাবে। ‘‘রাজ্যের মোট সাধারণ ও আইসিইউ শয্যার কত শতাংশ শয্যা এই জেলাগুলিতে আছে, তা বিশ্লেষণ করে সমাধানসূত্র খোঁজার সময় এসেছে,’’ বলেন অনির্বাণবাবু।
শয্যা বৃদ্ধিতে প্রতিকূলতাও কম নেই। রাজ্যের মোট ৮১টি কোভিড চিকিৎসা কেন্দ্রের মধ্যে ৫৪টিই বেসরকারি। পিয়ারলেসের সিইও সুদীপ্ত মিত্র বলেন, ‘‘শুধু শয্যা বাড়ালে হবে না। পর্যাপ্ত নার্স কই?’’ তিনি জানান, ভিন্ রাজ্যের যে-সব নার্স চলে গিয়েছিলেন, তাঁরা এখনও ফেরেননি। প্রতি বছরের মতো স্বাস্থ্য দফতর এ বারেও নার্স নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলে নতুন করে সঙ্কট তৈরির আশঙ্কা অমূলক নয়।
স্বাস্থ্য ভবনের খবর, ন’হাজারের বেশি নার্স নিয়োগের জন্য ওয়েস্ট বেঙ্গল হেল্থ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে ‘রিকুইজিশন’ দিয়ে রেখেছে স্বাস্থ্য ভবনের নার্সিং বিভাগ।
সংক্রামক রোগের চিকিৎসা পরিকাঠামো বিশেষজ্ঞ সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ক্লাস্টার মডেলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ছোট নার্সিংহোমগুলিকে ব্যবহার করতে হবে। করা হচ্ছেও। কিন্তু সমস্যা হল, সেটা করতে গিয়েও বহু এলাকার কিছু বাসিন্দা বাধা দিচ্ছেন। মানুষকে বুঝতে হবে, তাঁদের চিকিৎসার জন্যই এ-সব করা হচ্ছে।’’