ভিআরডিএল-এর করোনা-সেনানীরা। —নিজস্ব চিত্র
লকডাউনের মধ্যে পরিজনেরা কেমন আছেন, খোঁজ নেওয়ার ফুরসত নেই।
বাড়ি শুধু রাতটুকু কাটানোর ঠিকানা। আর রাত বলতেই বা কত টুকু? গভীর রাত পর্যন্ত ইউসিএম বিল্ডিংয়ের পাঁচতলার গবেষণাগারেই তো থাকেন এসএসকেএমের ভিআরডিএলে (ভাইরাস রিসার্চ ডায়াগনস্টিক ল্যাবেরেটরি) যোদ্ধারা। সদ্য বিবাহিত তরুণী বা বছর ছ’য়েকের কন্যার বাবা— সকলেরই ধ্যানজ্ঞান, ‘টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট’।
ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ রিসার্চ এবং আইসিএমআরের অর্থসাহায্যে গবেষণাগারটি তৈরি হয় ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। গত ১৭ মার্চ থেকে এসএসকেএমের ভিআরডিএলে করোনা-পরীক্ষা শুরু। মাইক্রোবায়োলজির বিভাগীয় প্রধান তথা ভিআরডিএল প্রজেক্টের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর, চিকিৎসক রাজা রায় জানান, এখন প্রতি দিন গড়ে ৯০টি নমুনা পরীক্ষা করছেন তাঁরা। উত্তর ২৪ পরগনার নমুনা পরীক্ষা হওয়ার কথা আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু এখনও সেই ল্যাব পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় দুই ২৪ পরগনার দায়িত্ব তাঁদের। সম্প্রতি শহরের বেশ কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজে করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শে চলে আসায় চিকিৎসক-স্বাস্থ্য কর্মীদের নমুনা পরীক্ষা হয়েছে এখানেই।
আরও পড়ুন: করোনা-প্রতিরোধের লক্ষ্যে অ্যান্টিবডি টেস্টে প্রাধান্য হটস্পটকেই
আরও পড়ুন: হাওড়ায় বাড়ি? ঢুকতে দিল না এনআরএস, যন্ত্রণা নিয়েই বাড়ি ফিরে প্রসব, সদ্যোজাত বাঁচল না
বিভাগীয় প্রধান জানান, বিশেষ পদ্ধতিতে নমুনা সংগ্রহ করে তা ভিটিএমের (ভাইরাল ট্রান্সপোর্ট মিডিয়াম) মাধ্যমে ল্যাবে পৌঁছয়। ৪-৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় নমুনা চার ঘণ্টার মধ্যে গবেষণাগারে পৌঁছনোর কথা। নমুনা পৌঁছলে সেটি ‘বায়ো সেফটি ক্যাবিনেটের’ মধ্যে খুলতে হয়। পরবর্তী ধাপ আরএনএ নিষ্কাশন প্রক্রিয়া। সেই কাজে রয়েছেন রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট (ভিআরডিএল প্রজেক্ট) চিকিৎসক জয়িতা হালদার, টেকনিক্যাল অফিসার চিকিৎসক অনন্যা পাল। আরটিপিসিআরের (রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেন রিঅ্যাকশন) দায়িত্ব রয়েছেন মেডিক্যাল সায়েন্টিস্ট চিকিৎসক অরিত্র বিশ্বাস। কোনও নমুনা পজ়িটিভ কি না, তা আরটি পিসিআরে দু’টি পর্যায়ের মাধ্যমে নির্ধারণ হয়— স্ক্রিনিং এবং কনফার্মেটরি টেস্ট। আরটিপিসিআরে সহযোগীর ভূমিকায় রয়েছেন জুনিয়র রিসার্চ ফেলো উজ্জ্বয়িনী রায়। এমস-সিডিসি প্রকল্পে হাসপাতালের সংক্রমণের উপরে কাজ করছিলেন তরুণী গবেষক। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে এখন তিনিও ভিআরডিএলের সেনানী।
টেকনিক্যাল দলকে অভিভাবকত্ব দিয়ে আগলে রেখেছেন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হীরকজ্যোতি রাজ, মেডিক্যাল সায়েন্টিস্ট চিকিৎসক রাজা রায় এবং ইন্টিগ্রেটেড ডিজ়িজ সার্ভেল্যান্সের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর বিশ্বনাথ দাস এবং প্রদীপ বালা। মাইক্রোবায়োলজির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হীরকজ্যোতি যখন গভীর রাতে বাড়ি ফেরেন তখনও তাঁর অপেক্ষায় জেগে থাকে ছ’বছরের কন্যাসন্তান। তিনি বলেন, ‘‘আমার চেয়ে বাড়ির লোক বেশি কষ্ট পাচ্ছে। আমার জন্য চিন্তা করছে, আবার সাহায্যও করছে। যত রাতেই বাড়ি ফিরি, সকলে অপেক্ষা করে থাকে।’’
গত মার্চে বিয়ে হয়েছে টেকনিক্যাল অফিসার অনন্যা পালের। তবে জীবনের নতুন পর্ব ভুলে সদ্য বিবাহিতা এখন গবেষণাগারেই ব্রতী। অনায়াসে বললেন, ‘‘আমার স্বামীও চিকিৎসক। সে জন্য বোঝে, এখন এই কাজই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’’ রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট জয়িতার পরিবার বলতে তাঁর ভাই অর্ণব। লকডাউনের মধ্যে রান্না-সহ বাড়ির যাবতীয় কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। জয়িতার কথায়, ‘‘বাবা-মা দু’জনকেই হারিয়েছি। ভাই বাড়ি থেকে কাজ করছে, আবার ঘরও সামলাচ্ছে। এই সমর্থন ছাড়া লড়াই সম্ভব ছিল না।’’ অরিত্রও যেমন বলেন, ‘‘লকডাউনের মধ্যে পরিবারের কী প্রয়োজন, খোঁজ নেওয়ার সময় কোথায়? বাবা-মা বয়স্ক। স্ত্রী আছেন। সব ওরাই সামলাচ্ছে। এই লড়াইয়ে মনের জোরই সব।’’ পরিবার তো বটেই, বিভাগীয় প্রধান রাজা জানাচ্ছেন, তাঁদের সমানে উৎসাহ জুগিয়েছেন রাজ্য সরকার, এসএসকেএমের অধিকর্তা মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায়, উপাধ্যক্ষ রঘুনাথ মিশ্র। তবে সব ছাপিয়ে ফুটে উঠেছে দলের জন্য তাঁর অসীম গর্ব।
অবশ্য এমন দলের জন্য গর্ব হওয়াই স্বাভাবিক। পরিবারের জন্য মন খারাপ লাগে না, এই প্রশ্ন শুনে তাঁর সমনামী সতীর্থ, অভিজ্ঞ মেডিক্যাল সায়েন্টিস্ট রাজা রায় সপাটে বলেছিলেন, ‘‘বাড়ির কথা ভাবব? সারা দেশ বিপদে। এখন নিজের কথা ভাবলে হবে?’’
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)